× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শ্রদ্ধাঞ্জলি

খণ্ড খণ্ড মেঘের মতো ভেসে এলো দুঃসংবাদ

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রকাশ : ২৪ মার্চ ২০২৪ ০৯:৫৬ এএম

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৪ ১৩:১৮ পিএম

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

২২ মার্চ রাত ৯টা ২০ মিনিট। জিয়া ভাইয়ের (ড. জিয়া রহমান) সঙ্গে দীর্ঘ ১৮ মিনিট ফোনালাপ। আমার উদ্দেশে তার শেষ কথা- ‘দাদা, আপনার কথা কখনও ফেলিনি, ফেলবও না। মামুনকে বলবেন যোগাযোগ করতে ওকে সময়টা বলে দেব।’ জিয়া রহমানকে আমি ‘স্যার’ বললে তিনি বারবার তাতে আপত্তি জানাতেন। বলতেন, ‘আমার ও আপনার সম্পর্ক দাদা ও ভাই। স্যার নয়।’ ২২ মার্চ রাতে সমাজবিজ্ঞানী জিয়া ভাইয়ের কাছে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান নিয়ে তার বিশ্লেষণ চেয়েছিলাম। মামুন (আমার অনুজ সহকর্মী মামুন রশীদ) সম্ভবত রাতেই তার সঙ্গে কথা বলে সময় নিয়েছিলেন। না, সে সময় আর আসেনি, আসবেও না; জিয়া ভাই অনন্তের পথে চলে গেলেন! কোনোভাবেই এমন দুঃসংবাদের জন্য সশঙ্কচিত্তে জিয়া ভাইকে ঘিরে আমাদের কারও উৎকণ্ঠা ছিল না। কখন যেন টুকরো টুকরো সাদা মেঘের মতো ভেসে আসে এমন দুঃসংবাদ, এর কোনো প্রেক্ষাপটই আমাদের সামনে ছিল না। অথচ বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে গেল!


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ২২ মার্চ দিবাগত শেষরাতে অর্থাৎ ২৩ মার্চ ভোরে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে। আমার বাসা থেকে জিয়া ভাইয়ের বাসার দূরত্ব বড়জোর ২০-২৫ মিনিটের হাটার পথ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শহীদ মুনীর চৌধুরী ভবনে থাকতেন। তার পরও তার সঙ্গে দেখা হতো কম, কিন্তু কথা হতো অনেক বেশি। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক জিয়া রহমানের জীবনাবসান ঘটায়। আমৃত্যু তিনি  ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব ক্রিমিনোলজির বোর্ড ডিরেক্টর ছিলেন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেরও ডিরেক্টর ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন দশকের চাকরিজীবনে শিক্ষক সমিতি ও বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন জিয়া রহমান।

২২ মার্চ রাতে জিয়া ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপের সূচনা করেছিলেন তিনি অভিমানের সুরে। বললেন, ‘দাদা, আপনারা খুব ভালো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা করলেন তিন পর্বে। অথচ আমি নেই সেখানে। শফি ভাই বা আপনি আমাকে লিখতে বললেন না! শফি ভাইকে বলবেন (মুস্তাফিজ শফি, সম্পাদক, প্রতিদিনের বাংলাদেশ), আমি পরশু শাহজাদপুর আসব একটা কাজে। সেখান থেকে আপনাদের অফিসে আসার ইচ্ছা আছে। থাক, আপনি বলবেন না; আমিই আপনাকে নিয়ে শফি ভাইকে অনুযোগটুকু জানাব।’ কথাটুকু শেষ করেই তার সেই অট্টহাসি। এ সারল্যই ছিল তার অঙ্গভূষণ। ামার অনুভূতি হচ্ছিল, ওই  অট্টহাসি যেন আমার কর্ণকুহরে জিয়া ভাইয়ের ভালোবাসার সবটুকু উচ্ছ্বাস ঢেউয়ের মতো উপচে পড়ছে। না, জিয়া ভাই, আপনার শফি ভাইকে আর অনুযোগ জানাতে হবে না। আপনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। আমার সম্পাদক শফি ভাই আমার কাছ থেকে এ বেদনাকাতর খবরটি পেয়ে শুধু বিমর্ষ হয়ে হচকিতভাবে উচ্চারণ করলেন, ‘বলেন  কী! জিয়া ভাই, বলার তো সত্যিই কিছু নেই, একেবারেই কিছু নেই।

চীনের নেতা মাও সে তুং লিখেছিলেন, ‘কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারী।’ হ্যাঁ, জিয়া ভাই; আপনার আকস্মিক চিরপ্রস্থান মাও সে তুংয়ের কথাটিই আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। আপনার এমন মৃত্যু সত্যিই থাই পাহাড়ের চেয়ে বেশি ভারী বলে মনে হচ্ছে আমাদের কাছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আপনার পরিবারকেই নয়, শোক ও বেদনা স্পর্শ করেছে সমাজের বিভিন্ন স্তর। আপনি শিক্ষকদের অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, দলীয় আদর্শের (আওয়ামী লীগ) অনুশীলনকারী হয়েও দলের ভুল সিদ্ধান্ত কিংবা বলবান নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে উচিত কথা বলতে কখনও কুণ্ঠিত হতেন না। এর বিস্তর নজির রয়েছে দেশের প্রিন্ট মিডিয়ার পাতায় পাতায়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার টকশোগুলোয়। আমাকেই তো আপনি বহুবার বলেছেন, ‘দাদা, কখন নাই হয়ে যাইÑএর হিসাব নাই, কিন্তু আপনারা তো সাক্ষী হয়ে আছেন, জিয়া রহমান কিছু পাওয়ার সমীকরণ কষে কিছু বলে না।’ সত্যিই, তাই ভাই; একদম সত্যি কথা। একটুও বাড়িয়ে বলেননি। আপনার সমালোচকও এ সত্য হয়তো অস্বীকার করবে না।

আপনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার তখনকার নিবাস ৭ নম্বর বাংলোয় থাকতেন খুব আড্ডা হতো আমাদের। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অবধি আমাকে এগিয়ে দিয়ে আসতেন আজিমপুরের দিকে যেতে। আলোচনায় থাকত বিদ্যমান ব্যবস্থার নানান অসঙ্গতি নিয়ে কথার পাশাপাশি সম্ভাবনার পথ ধরে এগিয়ে যেতে সরকারের কী করণীয় সেসবও। আপনি খুব আশাবাদী মানুষ ছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সেই বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ার। আপনিই কিছুদিন আগে কথা প্রসঙ্গে আমাকে এও বলেছিলেন, টানা চতুর্থবারসহ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-উত্তর পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠনকারী দল আওয়ামী লীগের এবার উচিত বাহাত্তরের সংবিধানের পূর্ণ অবয়ব ফিরিয়ে দেওয়া। এ নিয়ে একটি টেলিভিশনের টকশোয় কবে আমি ও আপনি এক সঙ্গে কথা বলেছিলাম সেই বিস্মৃত কথাও আপনি সেদিন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। সত্যিই আপনার স্মৃতি এত প্রখর এর প্রমাণও বহুবার পেয়েছি। আজ সেসব কিছুর শূন্যতা বোধ করছি খুব।

২৩ মার্চ খুব ভোরে মুঠোফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙে। আঁতকে উঠি, না জানি কোন দুঃসংবাদের বার্তা দিতে এত সকালে এই রিং টোন। ঘুমচোখে ফোনের স্ক্রিনে সাইফুলের (সাবেক সহকর্মী সাইফুল ইসলাম) নাম দেখে ফোন রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে বলতে থাকে, ‘দাদা, স্যার তো আপনাকে কতটা ভালোবাসতেন তা আমি দেখেছি তাই খবরটা দিতে বাধ্য হচ্ছি। জিয়া স্যার আর নেই।’ এটুকু বলে সাইফুলের কণ্ঠ জড়িয়ে যায়। আমার চিবুক গড়িয়ে পড়তে থাকে চোখের নোনা জল। গত রাত ৯টা ২০ মিনিট থেকে আজ যখন দুঃসংবাদটি পেলাম ২৩ মার্চ সকাল ৬টা ৩৫ মিনিট সময়ের ব্যবধান কত, নিজেই নিজেকে প্রশ্নটি করে আরও প্লাবিত হতে হই অশ্রুজলে। লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হবে তখন জিয়া ভাইয়ের সাথে আমাদের জাগতিক সম্পর্কের একটি দিন অতিক্রান্ত অতীত হবে। এই তো জীবন, এই তো সময়ের অধ্যায়, এই তো সময়ের জন্মমৃত্যু! এই আমাদের কত কিছু পাওয়ার আশার বিসর্জন! প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মেরুকরণের সমীকরণে কত রকমের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, যেসব বিষয়ের উপযোগিতা ক্ষয়ে যায় নিমেষে, তবু আমাদের অনেকেরই সংবিৎ ফেরে না। জিয়া ভাই, এ কথাগুলোও আপনি আলাপে-আলাপে বলতেন।

এই তো কদিন আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অবন্তিকার আত্মহননের পর আমাকে বলছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়টি ক্রমেই যেন মলিন হয়ে যাচ্ছে কারও কারও বন্যতায়। যখন অনাচার-দুরাচার কিংবা অন্যায়ই নিয়ম হয়ে যায়, তখন সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দুরূহ হয়ে পড়ে। মূল্যবোধ ধসে পড়ছে এবং এর কারণও বহুবিধ।’ মিথ্যা নয়, একটুও মিথ্যা নয় জিয়া ভাই। এ সমাজ ক্রমাগত মানুষ হারাচ্ছে আর মানুষরূপী বন্যদের বিচরণভূমি বিস্তৃত হচ্ছে। সমাজটা সত্যিই যেন বন্যদের চারণভূমি হয়ে পড়ছে। অপরাধের নানামাত্রিক ব্যাপ্তি ও বিদ্যমান সংকট নিরসনে করণীয় কীÑএ পরামর্শ নেওয়ার জায়গাও ক্রমেই হচ্ছে সংকুচিত। আর কখনও রাতবিরাতে জ্বালাব না এ দাবি নিয়ে যে, জিয়া ভাই; ঘটে যাওয়া ওই ঘটনাটি নিয়ে আপনার দ্রুত বিশ্লেষণ চাই। সময় খুব কম দ্রুত চাই জিয়া ভাই, খুব দ্রুত। আপনার ৫৮ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের কর্ম অধ্যায়ের স্তরে স্তরের আলোয় আপনি আমাদের সামনে থাকবেন আমাদেরই প্রয়োজনে, বড় বেশি প্রয়োজনে।

আপনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা। জিয়া ভাই, বেদনায় সময়ের ভরে যাওয়া পেয়ালার ভার বয়ে চলা আমাদের অনেকের পক্ষে কঠিন, খুব কঠিন। তবে আপনার সাহসী উচ্চারণ আমাদের কর্মের ক্ষেত্রে হয়ে থাকবে খুব শক্তিসঞ্চারক। প্রিয়জনের বিয়োগজনিত ব্যথার থেকে বড় কাতরতা বোধহয় আর কিছুই হয় না। স্মরণ করছি অস্ট্রেলিয়ান রাজনীতিক এডওয়ার্ড সেন্ট জনকে। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পরেও যে জিনিস মানুষের মনে অম্লান হয়ে থাকে সেটা হলো তার ব্যবহার এবং মানুষের অন্তরে নিজেকে প্রোথিত করার কর্মগুণ।’ আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর ঝর্ণা স্থির করে তোলে জীবনের জলকে।’ এ দু-ই খুব সত্যি আপনার ক্ষেত্রে। আপনি আমাদের সম্পদ হয়েই থাকবেন। ভালো থাকুন জিয়া ভাই, ওপারে খুব ভালো থাকুন।

  • সাংবাদিক , কবি ও লেখক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা