বাংলাদেশি জাহাজ জিম্মি
মুহাম্মদ জামিল উদ্দিন
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৪ ০১:৫৭ এএম
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৪ ০১:৫৮ এএম
২৩ নাবিকসহ আমাদের একটি জাহাজ এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে বন্দি। ১২ মার্চ কেএসআরএম গ্রুপের (কবির গ্রুপ) মালিকানাধীন এসআর শিপিংলাইনসের জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ও এর ২৩ নাবিককে ছিনতাই করে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। একই কোম্পানির জাহাজ এমভি জাহান মণি ছিনতাই হয়েছিল ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর। সে সময় জলদস্যুরা যোগাযোগ করতে দুই সপ্তাহ সময় নিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা থাকার পরও এবার সবার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অনেক বেশি। কারণ ভারত ও যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনী এমভি আব্দুল্লাহকে অনুসরণ করে এবং পরে তারা অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নেয়, যার ফলে নাবিকদের জীবন হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা করা হয়। তবে আশার কথা, টানা আট দিন রুদ্ধশ্বাস পেরোনোর পর অবশেষে নাগাল মিলেছে সোমালীয় জলদস্যুদের।
২১ মার্চ প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০ মার্চ দুপুর ১২টার পর জলদস্যুরা তৃতীয় পক্ষের
মাধ্যমে এসআর শিপিংলাইনস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশের
প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, জিম্মি নাবিকদের নিয়ে জাহাজটি এখন সোমালিয়ার নুগাল প্রদেশের
উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর গদবজিরানের কাছাকাছি নোঙর করা অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই
সোমালিয়া উপকূলে বাণিজ্য জাহাজের চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও আগে সোমালিয়ান উপকূলের অল্প
কিছু এরিয়া ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু কাঁচা ডলারের লোভ, সোমালিয়ার রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব
ও দুর্ভিক্ষ তাদের জলদস্যুদের এতই দুঃসাহসী করেছে যে, এখন ভারত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূল
চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে গণ্য। বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে এ এলাকায় বাড়তি কিছু সতর্কতা
অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু এমভি আব্দুল্লাহর দুর্ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট
হয়, জাহাজটির সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটিতে কিছু অবহেলা ছিল। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কী হয়নি
বা কী হতে পারত বা দোষ খুঁজে বের করা হয়তো সহজ, কিন্তু তাতে ঘড়ির কাঁটা পেছনে ঘুরিয়ে
প্রেক্ষাপট এড়ানো সম্ভব নয়। তবে এর থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব
বা অন্যরাও সতর্ক হতে পারে।
২০১০ সালে এসআর
শিপিংয়ের এমভি জাহান মণি সোমালিয়ান পাইরেটসের হাতে পড়ে। ১০০ দিন পর মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজ
ও নাবিকরা মুক্তি পায়। একই এলাকায় একই কোম্পানির আরেকটি জাহাজ বাড়তি সিকিউরিটি ছাড়া
কীভাবে যাত্রা করল? সোমালিয়ান উপকূলে বাণিজ্যিক জাহাজের জন্য আর্মস গার্ড ভাড়া পাওয়া
যায়। ২০১৫-১৬-এর দিকে আমরা ফুজাইরা থেকে লোহিত সাগরে যাচ্ছিলাম। কোম্পানি আমাদের জাহাজে
পাঁচজন আর্মস গার্ড দেয়। ওরা হরমুজ প্রণালির পর জাহাজে উঠে লোহিত সাগরে ঢোকার মুখে
বাবেল মান্ডেব নামক স্থানে নেমে যায়। ব্রিটিশ একটি সিকিউরিটি কোম্পানির আওতায় ওখানে
ব্রিটিশ এক্স নেভি, সাউথ আফ্রিকান এক্স নেভিসহ বিভিন্ন দেশের ট্রেন্ড লোক কাজ করে।
এডেন উপসাগরে ছোট একটি বোট আমাদের জাহাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আর্মস গার্ড ফাঁকা গুলি
ছোড়ার পর ওরা জান নিয়ে পালায়। ওই বিপজ্জনক এলাকায় ছয় দিন আর্মস গার্ড ছিল, সম্ভবত ৩০
হাজার ডলার পে করেছিল আমাদের কোম্পানি। এসআর শিপিং জাহান মণির ঘটনার পরও কেন এমভি আব্দুল্লাহ
ওই এলাকায় আর্মস গার্ড নিল না? কিছু ডলার বাঁচাতে গিয়ে কি এখন মিলিয়ন ডলারের গচ্চা
দিতে হবে না? এ ছাড়া ২৩ জন হতভাগা নাবিক ও তাদের পরিবারের দুঃসহ বোঝা।
এমভি আব্দুল্লাহ
ছিনতাইয়ের সময়ের বেশ কিছু হোয়াটসঅ্যাপ এবং ভিডিও বার্তা অনলাইনে মিলেছে। বিশেষ করে একজন দুর্ধর্ষ পাইরেট রশি বেয়ে
কীভাবে ডেকে উঠে আসছে। কলজে হিম করা এ দৃশ্য ওই জাহাজের কোনো না কোনো ক্রু ভিডিও করেছেন
নিশ্চয়ই। কিন্তু জাহাজের রেলিং ধরে কোনো নিরাপত্তা রিং চোখে পড়েনি। সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ
সীমানায় যাওয়ার সময় জাহাজের আগাগোড়া রেলিং ধরে কাঁটাতারের নিরাপত্তা বেষ্টনী পেঁচিয়ে
নিতে হয়, এবং এর ফলে জলদস্যুরা ওই কাঁটাতার ভেদ করে সহজে ডেকে উঠতে পারে না। এ ছাড়া
জাহাজের অফিসাররা যদি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সঠিক নিরাপত্তার ঝুঁকির বিষয়টি বুঝে অফিসকে
জানাতেন, উচ্চ ঝুঁকিপর্ণ এলাকায় যাওয়ার আগে তাদের পর্যাপ্ত কাঁটাতারের নিরাপত্তা বেষ্টানী
লাগবে, তাহলে কি অফিস তা না দিয়ে পারত? ভুলটা যারই হোক, দায়িত্ব কারওই এড়ানোর সুযোগ
নেই।
জলদস্যুপ্রবণ
এলাকায় জাহাজের নাবিকদের জন্য আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা আশ্রয় আাছে। তা হলো
ক্যাথিড্রাল। কিছু কিছু জাহাজে স্টিয়ারিং রুমকে সিটাডেল বানানো হয়, আবার কিছু জাহাজে
পুরো ইঞ্জিন রুমকে সিটাডেল বানানো হয়। এতে সুবিধা হলো সবাই ইঞ্জিন রুমে এসে ইঞ্জিনের
কন্ট্রোল নিয়ে নিলে জলদস্যুরা আর কিছু করতে পারে না। সিটাডেলের নিয়ম হলো, স্টিয়ারিং
রুম বা স্টিয়ারিং রুমসহ পুরো ইঞ্জিন রুম যদি সিটাডেল হয়, তাহলে পাইরেসি এরিয়ায় স্টিয়ারিং
রুম ও ইঞ্জিন রুমের সব দরজা ভেতর থেকে লক করা থাকবে। অধিকতর সেফটির জন্য প্রতিটি দরজায়
পুরু পাতের স্টিলের ডোরপ্লেট লাগিয়ে এমনভাবে ভেতর থেকে লক করা থাকবে, পাইরেটসরা শত
চেষ্টা করেও বাইরে থেকে খুলতে বা ভাঙতে পারবে না। সিটাডেলে কিছু ড্রাই ফুডস ও পানি,
স্যাটেলাইট ফোন ও রেডিও থাকে। ফলে সিডাটেলে বসেই আন্তর্জাতিক সহায়তা কেন্দ্রে যোগাযোগ
করলে আশপাশের নৌবাহিনীর জাহাজ এসে জলদস্যুদের ধরতে বা তাড়াতে পারবে। সোমালিয়ান উপকূলে
এভাবে কয়কটি জাহাজ রক্ষা পেয়েছে।
এমভি আব্দুল্লাহয় কি এ রকম সিটাডেল ফ্যাসিলিটি ছিল? স্টিয়ারিং রুম ও ইঞ্জিন রুমকে সিটাডেল বানাতে খুবই অল্প টাকা খরচ হয়। যেহেতু এসআর শিপিংয়ের জাহাজ ওসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করে তাই প্রতিটি জাহাজে সিটাডেল করে ক্রুদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং দেওয়া দরকার। আমাদের অনেক জাহাজ কোম্পানিই নিরাপত্তা চেয়ে বাণিজ্যিক দিকটিতেই বেশি প্রাধান্য দেয়, কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, এমভি আব্দুল্লাহ এরই সর্বশেষ উদাহরণ। নিজেদের নিরাপত্তার দিকটি নিজেদেরই দেখতে হবে। এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এমভি আব্দুল্লাহ ও তার ২৩ জন ক্রু দ্রুত মুক্তি পাকÑএ প্রার্থনা।