× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রাজনীতি

জাতীয় পার্টি কোন পথে

মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪ ১০:৫৯ এএম

মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী

মমতাজউদ্দিন পাটোয়ারী

জাতীয় পার্টিতে আরেকবার ভাঙন ঘটেছে। উভয় পক্ষের দাবি, তারাই মূলধারার। তবে গণমাধ্যমে আসা জাতীয় পার্টির দুই নেতৃত্বের পরিচয়ে একটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, অন্যটির চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিশনে অনুষ্ঠিত ৯ মার্চের সম্মেলনের মাধ্যমে রওশন এরশাদ দলের চেয়ারম্যান হয়েছেন। সেখানে অবশ্য জিএম কাদের এবং তার অংশের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ওই সম্মেলনে দাবি করা হয়, সারা দেশের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের সম্মতিতেই বেগম রওশন এরশাদ চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন কাজী ফিরোজ রশীদ, মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ, সাদ এরশাদকে দলের অন্যতম কো-চেয়ারম্যান করা হয়। সম্মেলনে বেগম রওশন এরশাদ বলেছেন, ‘আজকে সম্মেলন না হলে জাতীয় পার্টি হারিয়ে যেত। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম। দেশের মানুষ জাতীয় পার্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। এরশাদ এ দেশে যে নতুন ধারার ইতিবাচক রাজনীতির প্রবর্তন করেছিলেন, সে রাজনীতি হারিয়ে যেতে বসেছিল। আজ এ দশম সম্মেলনের মাধ্যমে পল্লীবন্ধু এরশাদের নীতি-আদর্শ এবং উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ও সংস্কারের রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’ রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন গঠিত জাতীয় পার্টিতেও ভাঙনের সুর শোনা গেছে ইতোমধ্যে।


২০১৯ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর আগেই দলের ভবিষ্যৎ কান্ডারি কে হবেন তা নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছিল। এরশাদের মৃত্যুর পর জিএম কাদের দলীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব এবং বেগম রওশন এরশাদ সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও জিএম কাদের বিরোধীদলীয় উপনেতার পদগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দলের নবম সম্মেলনে জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান এবং রওশন এরশাদকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করা হয়। এ সময়ে দুজনের মধ্যে নানা বিষয়ে দ্বিমতের বহু ঘটনা ঘটেছে। জিএম কাদের এরশাদের মতোই কাউকে অব্যাহতি দেওয়া আবার কাউকে কাছে টানা নীতির অনুসরণ করেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়। শারীরিক অসুস্থতায় দলের জন্য রওশন এরশাদের সময় দেওয়া সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় দলের অভ্যন্তরে দুটি পরস্পরবিরোধী গ্রুপ তৈরি হয়Ñএকটি রওশন এরশাদ, অন্যটি জিএম কাদেরকে কেন্দ্র করে। জিএম কাদের দায়িত্ব নিয়ে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং মনে হয়েছে তিনি দেশে নির্বাচন ঘিরে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখে সুযোগমতো অবস্থান নেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এ নিয়ে দলের মধ্যে নানা ধরনের অস্বস্তি ও বিভক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

জিএম কাদেরের পক্ষে এবং বিপক্ষেও দলাদলি বৃদ্ধি পায়। দলকে সাংগঠনিকভাবে গড়ে তোলার পরিবর্তে তিনি নির্বাচনে সুযোগ বুঝে অবস্থান নেওয়ার নীতি-কৌশলই নিয়েছিলেন। সেটি নির্বাচনে তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর প্রকট আকার ধারণ করেছিল। নির্বাচনে আসন বৃদ্ধির নানা কৌশলও তিনি অবলম্বন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিলেও জিএম কাদের তার অনুসারীদের বাইরের কাউকেউ দলীয় মনোনয়ন দেননি। এমনকি রওশন এরশাদসহ এরশাদ পরিবারের কাউকেই নয়। এ নিয়েও দলে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ওই বিরোধ দলকে ভাঙনের দিকেই নিয়ে যায়। নির্বাচনে জিএম কাদের দেশব্যাপী ২৮৯ জনকে বিভিন্ন আসনে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। মনোনয়ন দেওয়াই যেন শেষ কথা, তিনি নিজে দলীয় প্রধান হিসেবে কোনো প্রার্থীর আসনে প্রচারে গেছেন এমনটি দেখা যায়নি। ফলে নির্বাচনে জাতীয় পার্টির তিনিসহ ১১ জন জয়লাভ করলেও গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই পরাজিত হন। যে ১১টি আসনে জাতীয় পার্টি জয়লাভ করে সেগুলোয় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক ছিল না। ফলে জাতীয় পার্টিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। জাতীয় পার্টি এতেও খুশি ছিল না। তারা চেয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরিবেশ। কিন্তু তা না থাকায় তাদের অন্য প্রার্থীরা জয়ী হতে পারেননি। এ নিয়ে জিএম কাদের আওয়ামী লীগের ওপর ক্ষুব্ধ হন। তার স্ত্রী ঢাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান।

জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে কখনোই জনগণের মধ্যে দলীয় আদর্শ, নীতি, কৌশল ইত্যাদি প্রচার ও প্রসার ঘটিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেনি। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থেকে বিএনপির মতোই কিছু সুবিধাবাদী মানুষ নিয়ে দল গঠন করেছিলেন। ওই বছর সংসদ নির্বাচনে তিনি দলকে মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে জয়ী করিয়েছিলেন। এরপর ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে আ স ম আবদুর রবকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়ে সংসদ গঠন করেন। প্রায় সব দলই সে নির্বাচন বর্জন করে। দেশে তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। ১৯৯০-এর শেষে আন্দোলনের জোয়ারভাটার একপর্যায়ে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। তিনিসহ জাতীয় পার্টির অনেকেই গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে খুব একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে না পারলেও কারাবরণ তার জন্য শাপেবর হয়। ১৯৯১-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে তার দল ৩৫টি আসনে জয় লাভ করে। তিনি একাই পাঁচ আসনে জয়ী হন। রাজনীতিতে তার এ উত্থান ছিল উত্তরাঞ্চলে জনগণের আবেগ এবং নেতৃত্বশূন্যতার প্রতিফলন। এ দুই বাস্তবতা অবলম্বন করে জাতীয় পার্টি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি পায়।

১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনেও দলটি এ অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। তবে রাজনীতিতে তার দলের আদর্শগত অবস্থান বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে বাস্তব কিছু সমস্যা ছিল। তিনি আদর্শগতভাবে কখনও ডান, কখনও মধ্যম অবস্থানে ওঠানামা করছিলেন। ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়। বড় ভাই বিএনপি, ছোট সৎ-ভাই জাতীয় পার্টি একমঞ্চে টিকতে পারে নাÑএ সত্যটি এরশাদের কাছে যত স্পষ্ট হতে থাকে ততই তিনি মঞ্চ থেকে ছিটকে পড়েন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভাগ্যে মাত্র ১৪টি আসন জোটে। এরশাদের রাজনৈতিক জীবনে এ সময়টি ছিল কেবলই নিম্নগামিতার। তবে ওই সময়ে জোট সরকারের অত্যাচারে আওয়ামী লীগই কেবল সংকীর্ণ হওয়ার অবস্থানে ছিল না, অসাম্প্রদায়িক সব গোষ্ঠী চারদলীয় জোটের রোষে পরিণত হয়েছিল। ২০০৬-এর নির্বাচন প্রাক্বালে ১৪-দলীয় এবং জাতীয় পার্টিসহ বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা এলডিপি মহাজোট গঠন করলে দেশের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু চারদলীয় জোট একতরফা নির্বাচন করতে গিয়ে দেশে ভয়ানক হানাহানি পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে এক-এগারোর ঘটনা ঘটে। দুই বছর দেশে মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন বিরাজনীতিকরণের মিশন নিয়ে ক্ষমতায় জেঁকে ছিলেন। দেশ ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ায় তারা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন।

জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে তৃতীয় স্থানে পুনরায় ফিরে আসে। বিএনপির সঙ্গে সংসদে আসনের অবস্থানে পিঠাপিঠি ছিল। জাতীয় পার্টি সে সময় ক্ষমতার অংশ হতে গিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে সাংগঠনিকভাবে দেশব্যাপী নিজেকে তৈরি করার অপূর্ব সুযোগটি হাতছাড়া করে। ক্ষমতায় থেকে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বৃত্তেই ঘুরতে চায় সেটি আবারও প্রমাণ করে। ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনেও দলটি আসন ভাগাভাগিকেই প্রাধান্য দিয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে দলটি ছয়বার ভাঙনের কবলে পড়েছে। তাতে দলীয় আদর্শের বিরোধের চেয়ে ক্ষমতালাভের হিসাবনিকাশই প্রাধান্য পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। কিন্তু এ স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বশূন্য করেছিল। যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তারা দেশটাকে আদর্শের রাজনীতিশূন্য করতে পেরেছে, আদর্শপুণ্য করার উদ্দেশ্য তাদের ছিল না।

জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে আদর্শের ধার ধারেনি। দলটি এখন পরগাছা, গৃহপালিত এবং পরাশ্রয়ী হয়ে যেটুকু আছে তা-ও হয়তো একদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি দলের নেতৃত্ব হানাহানি, দলাদলি, গৃহবিবাদ ত্যাগ করে মধ্যপন্থার রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণের মাধ্যমে দেশব্যাপী সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরির উদ্যোগ নেন, তা হলেই কেবল এর একটি নতুন রূপ রাজনীতিতে দেখা যেতে পারে

  • রাজনীতি-বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা