সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪ ১২:৪৩ পিএম
চট্টগ্রাম থেকে
ছেড়ে আসা জামালপুরগামী বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনটির নির্দিষ্ট গন্তব্য জামালপুরে যাওয়ার
পথে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার হাসানপুরে দুর্ঘটনায় পুরোনো সন্দেহ নতুন করে সামনে
এসেছে। তৈরি হয়েছে কিছু প্রশ্ন। ১৮ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর শীর্ষ প্রতিবেদনে
এরই প্রতিফলন উঠে এসেছে। ‘বিজয় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় নাশকতার আলামত’ শিরোনামে প্রকাশিত
প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে তাতে নাশকতার সন্দেহ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দুর্ঘটনার
পর কুমিল্লার রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার বলেছিলেন, গরমে রেললাইন বেঁকে গিয়ে দুর্ঘটনা
ঘটতে পারে। কিন্তু পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তার এ বক্তব্যের পক্ষে যৌক্তিক কোনো কারণ
খুঁজে পাননি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা। কিন্তু তারাও যে মন্তব্য করেছেন
এরও যথার্থতার বিষয়টি প্রশ্নমুক্ত নয়। তাদের ধারণাপ্রসূত বক্তব্য, ২০৮ নম্বর রেলওয়ে
সেতুর নড়বড়ে কাঠে স্লিপার ও ত্রুটিপূর্ণ নাটবল্টু দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এ ব্যাপারে
তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে যথাযথ কারণ বের হয়ে আসুক এবং সেই
নিরিখে রেলপথের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে নজর রাখার পাশাপাশি যদি নাশকতার আলামত প্রমাণিত
হয় তাহলে কঠোর প্রতিবিধানের বিষয়টি দ্রুত নিশ্চিত করার তাগিদ দিই আমরা।
আমরা রেলওয়ের
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের দায়সারা বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি
কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। তারা যদি মনে করেন কিংবা জানেন ওই রেলপথের সেতুটির কাঠের স্লিপার
নড়বড়ে ও এর নাটবল্টু ত্রুটিপূর্ণ তাহলে আগেই ব্যবস্থা গ্রহন করে রেলপথ ঝুঁকিমুক্ত করার
ত্বরিত ব্যবস্থা নেননি কেন? এত জনগুরুত্বপূর্ণ একই সঙ্গে জীবনমৃত্যুর ঝুঁকি সম্পর্কে
উদাসীনতার দায় কি তাদের এড়ানোর অবকাশ আছে? এ ছাড়া রেলপথের নিরাপত্তা বিধানে কেনই বা
নিয়মিত তদারকি-নজরদারির ব্যাপারে দায়িত্বহীনতার ছায়া দৃশ্যমান? দেশে রেলপথে ত্রুটির
পাশাপাশি তেমনি রেল বা অন্য গণপরিবহনে নাশকতার কবলে পড়ার মর্মস্পর্শী নজির আমাদের সামনে
রয়েছে। এই দুই ব্যাপারেই কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্বের বিষয়গুলো অতিগুরুত্বপূর্ণ এবং নাশকতাজনিত
নিরাপত্তাহানির দায়ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষের ওপরই বর্তায়। আমরা আশা করি, যথাযথ
তদন্তের মধ্য দিয়ে প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে এবং প্রতিবিধানের ক্ষেত্রে কাজের কাজ দ্রুততার
সঙ্গে নিশ্চিত হবে।
দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন-কর্মসূচির নামে রেল ও সড়কপথে
গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগসহ বহুমাত্রিক নাশকতার ছায়া কীভাবে পড়েছিল এবং এর ফলে সৃষ্ট মর্মন্তুদ
ঘটনাগুলোর ক্ষত এখনও শুকায়নি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ওই মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তযোগ্য
প্রতিকার আজও নিশ্চিত হয়নি। আমরা বিস্মৃত হইনি, এর আগেও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের
নামে আন্দোলন ও কর্মসূচি পালনকালে পরিকল্পিতভাবে জনজীবনে মানবতাবিরোধী অভিঘাত কী ভয়ংকরভাবে
দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। অতীতের ভয়ংকরতম সৃষ্ট ক্ষতের প্রেক্ষাপটে এ রকম যেকোনো ঘটনা স্বাভাবিক
কারণেই যেমন প্রশ্ন দাঁড় করায় তেমনি প্রতিকারহীনতার প্রলম্বিত ছায়াও ক্ষুব্ধ না করে
পারে না। বিজয় এক্সপ্রেসের এতগুলো বগি লাইন থেকে ছিটকে পড়া ও প্রায় আধা কিলোমিটার রেললাইন
দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে আরও অনেক বড় মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। দুর্ঘটনার
কারণ অনুসন্ধানে গঠিত তদন্ত কমিটিকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে না দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে
প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আমরা আশা করি, দ্রততম সময় যেন কোনোভাবেই দীর্ঘায়িত না হয়।
স্বাধীনতার মাসে
আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ের বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব দিয়ে স্মরণ করতে চাই। মহান
মুক্তিযুদ্ধের মূল অঙ্গীকার ছিল মানুষের অধিকার ও জীবনের সঠিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে কতটা ঘাটতি এখনও রয়ে গেছে এর দুঃখজনক নজির ফিরে ফিরে
আমাদের সামনে উঠে আসছে। এরই প্রেক্ষাপটে আরও বলতে হয়, স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ও
নিরাপদ সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায় শুধু রাষ্ট্রশক্তির কিংবা প্রশাসনেরই নয়, রাজনৈতিক
দলসহ সমাজের বিভিন্ন কাঠামোরও কম নয়। এই সম্পাদকীয় স্তম্বেই আমরা ইতঃপূর্বে বহুবার
বলেছি, যোগাযোগ খাত, সামাজিক-রাজনৈতিকসহ যেকোনো ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার মাশুল যাতে
দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতার কারণে মানুষকে দিতে না হয়। দুর্ঘটনাকবলিত বিজয় এক্সপ্রেস
সেই তাগিদই পুনর্বার দিয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের এ ব্যাপারে যথাযথ দায়িত্ব পালনের
নিশ্চয়তার পাশাপাশি জবাবদিহির দাবি জানাই। অনভিপ্রেত হলেও সত্য, এত সব মর্মস্পর্শী
ঘটনার পাশাপাশি জীবনঝুঁকির নানা উপসর্গ জিইয়ে থাকলেও এগুলোর নিরসনে স্থায়ী প্রতিবিধান
নিশ্চিত হয় না। জনজীবনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো পক্ষের গাফিলতিই
মেনে নেওয়া যায় না।
ব্রিটিশদের হাত
ধরে আমাদের এই ভূখণ্ডে ট্রেনের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতার পরও সেই যাত্রায় ছেদ পড়েনি।
কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো রেলের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে দেওয়ায় যোগাযোগের অনেকটা
ঝুঁকিমুক্ত ও সাশ্রয়ী এই মাধ্যমটি কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে পিছিয়ে যায়। ধারাবাহিক আওয়ামী
লীগ সরকার সেই অবস্থা থেকে রেলকে রেব করে আনতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে
রেললাইনের পরিধি যেমন বিস্তৃত হয়েছে তেমনি রেলের বহরেও যুক্ত হয়েছে নতুন ও আধুনিক ইঞ্জিন-বগি।
কিন্তু রেলপথে নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও কতটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে দুর্ঘটনাকবলিত বিজয়
এক্সপ্রেস এরই সর্ব সাম্প্রতিক শেষ নজির। নাশকতা নাকি রেলপথের ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে
দেশবাসী বড় ধরনের ট্যাজেডির ভার বওয়া থেকে রক্ষা পেল এর যথাযথ অনুসন্ধানক্রমে দ্রুত
উপযুক্ত প্রতিবিধানই পারে কেবল রেলপথে বিদ্যমান নিরাপত্তাহীনতার ছায়া সরাতে। যোগাযোগের
মাধ্যম সড়কপথে নিত্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে জিইয়ে আছে নানা উপসর্গ। আমরা চাই অনেকটাই অনিরাপদ
যোগাযোগমাধ্যম রেলপথে যেন এর অপচ্ছায়া আর না পড়ে। প্রায়ই রেলপথে লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটছে।
এসব নানা প্রেক্ষাপটে একেবারে উৎসে নজর দিয়ে এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর
ব্যবস্থা নিতে হবে সময়ক্ষেপণ না করে।