সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪ ১০:৪৬ এএম
বুদ্ধদেব বসু
ইলিশ মাছ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন, ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’। হ্যাঁ, জলের উজ্জ্বল শস্য
তো বটেই, আমাদের জীবন চেবং সাহিত্যে ছড়িয়ে রয়েছে ইলিশ। রয়েছে ইলিশ নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতাও।
তবে এর পেছনের কার্যকারণও যথেষ্ট। বাঙালির ধারণা রূপে, গুণে, স্বাদে, গন্ধে বাংলার
ইলিশ শ্রেষ্ঠ। ইলিশের তুলনা শুধুই ইলিশ। ইলিশের প্রাচুর্য ছিল একসময়। ডিম ছাড়ার মৌসুমে
ঝাঁকে ঝাঁকে সমুদ্রের এই মাছটি নদীর মোহনা পেরিয়ে চলে আসত উজানে। এ সময় জেলের জালে
ধরা পড়ত আর বাঙালির রসনায় তৃপ্তি মেটাত। কিন্তু সেই ইলিশ যেন হারিয়ে যেতে বসেছিল। হারাতে
বসেছিল গৌরব ও ঐতিহ্য। কমতে শুরু করেছিল প্রাকৃতিক এই সম্পদের উৎপাদনও। ফলে বাঙালির
পাত থেকেও হারিয়ে যেতে বসে ইলিশের নানান পদ। মাছের বাজারে ইলিশের কদর বাড়লেও চাহিদা
অনুযায়ী জোগান না থাকায় নিম্নবিত্ত তো দূরের কথা মধ্যবিত্তের জন্যও ইলিশ হয়ে উঠতে থাকে
মহার্ঘ বস্তু। অথচ ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। ফলে এই মাছটি নিয়ে আমাদের হাপিত্যেশ বাড়ছিল।
তবে অবস্থা ঘুরতে
শুরু করেছে। গত প্রায় এক দশকে জাতীয় মাছ ইলিশ আহরণে বিপ্লব ঘটেছে। ইলিশ আহরণের পরিমাণ
বেড়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ইলিশের মোট উৎপাদন গত কয়েক বছর অনেক বেশি হচ্ছে। যার সাক্ষ্য
মিলেছে ১৭ মার্চ প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। ‘ইলিশের উৎপাদন ১৫
বছরে বেড়েছে ১০৫ শতাংশ’ শিরোনামের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় মা ইলিশ ধরা বন্ধ, জাটকা
সংরক্ষণ, অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠাসহ নানা উদ্যোগে দেশে ইলিশের উৎপাদন অব্যাহতভাবে বাড়ছে।
বছরের একটি নির্দিষ্ট
সময়ে সরকার ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে। যার ফলে রক্ষা পাচ্ছে মা ইলিশ। তারা নিরাপদে ডিম
ছাড়তে পারছে। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালে ২২ দিন মা
ইলিশ ধরা নিষিদ্ধকালে ইলিশের প্রজনন সফলতার হার ছিল ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ। ফলে চলতি বছর
৪০ হাজার ৫৮৫ কোটি জাটকা ইলিশ বেড়েছে, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রজনন মৌসুমে
মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করায় ডিম ফোটা এবং জাটকা সংরক্ষণ করায় ইলিশ তার জীবন চক্রটি পূর্ণ
করতে পারছে এবং একসময় আবার নদীতে ফিরে আসছে ডিম ছাড়ার উদ্দেশ্যে। ফলে দূর হচ্ছে ইলিশের
ঘাটতি। আমরা জানি, বাংলাদেশের মতো ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও একটি নির্দিষ্ট সময়ে মা ইলিশ
ধরা বন্ধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। অথচ দুই দেশের এই নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যে সমন্বয় নেই।
ফলে আমরা যখন মাছ ধরা কর্মসূচি বন্ধ রাখি তখন পশ্চিমবঙ্গের জেলেরা সাগরে মাছ আহরণ করে।
তাদের জালে ধরা পড়ে বিপুলসংখ্যক ইলিশ। অন্যদিকে আমরা যখন মাছ ধরা কার্যক্রম শুরু করি,
তখন তাদের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। ফলে আমাদের সংরক্ষিত ইলিশের ভান্ডারের অনেকটাই যথার্থ
পরিকল্পনার অভাবে বেহাত হয়ে যায়। তাই ইলিশ সংরক্ষণের অন্যান্য উদ্যোগের মতো, এদিকটিও
যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দেখা প্রয়োজন। ফলে ইলিশের যে বিপুল ঐশ্বর্য ও গৌরব তা যেমন ফিরে
আসবে তেমনি পর্যাপ্ত ইলিশের প্রাপ্যতার এটা করা গেলে আকাশছোঁয়া দামের পড়তিও দেখা যাবে।
ইলিশের উৎপাদন
বাড়ার খবর নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য সুখকর ও আনন্দবার্তা। কারণ ইলিশের উৎপাদন বাড়ায় দেশের
চাহিদা যেমন মিটছে তেমনি বাড়তি ইলিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম হচ্ছে।
এসবের পেছনে প্রধান কারণ, ইলিশ আহরণে নির্দিষ্ট সময় নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়ন। এতে ইলিশ
যেমন বড় হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে তেমনি অভয়াশ্রমগুলোতে জাটকা ধরা এবং নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ
আহরণ বন্ধ করায় উৎপাদনের সুফলও দৃশ্যমান। কিন্তু
বিশ্বে যে পরিমাণ
ইলিশ আহরণ হয় এর ৮০ শতাংশই উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। ইলিশ উৎপাদনব্যয় নেই, কিন্তু ইলিশ
আহরণব্যয় প্রচুর এবং ক্রমান্বয়ে এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়ছে। ব্যয় বাড়ার পেছনে
রয়েছে ট্রলারভাড়া, জ্বালানি খরচ, জেলে-শ্রমিক, জালভাড়াসহ আরও অনেক কারণ। ইলিশ যারা
আহরণ করেন সেই জেলেরা দরিদ্র শ্রেণির। তারা মহাজনদের থেকে দাদন নিয়ে ইলিশ আহরণ করেন।
বিস্ময়কর হলো, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইলিশ আহরণ করেন তাদের ভাগ্যে যা জোটে তা নামমাত্র।
ইলিশ উৎপাদন বাড়লেও তাই এর সুফল আহরণকারীরা যেমন পাচ্ছেন না, তেমনি পাচ্ছেন না ভোক্তারাও।
আমরা জানি, জাটকা ও মা ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞাকালে সরকার জেলেদের প্রণোদনা দেয়। কিন্তু
সরকারের এই প্রণোদনা জেলেদের কাছে ঠিকমতো না পৌঁছার অভিযোগও প্রচুর। তা ছাড়া নিষেধাজ্ঞার
সময়ে জেলেদের যে পরিমাণ প্রণোদনা দেওয়া হয়, তা-ও যথেষ্ট নয়। প্রণোদনা দিয়ে একটি পরিবারের
নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ব্যয়সংকুলান হওয়াও কঠিন। তাই জেলেদের ভালো রাখতে তাদের যেমন
সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা জরুরি, তেমনি নিষেধাজ্ঞার সময়ে তাদের
প্রণোদনার পরিমাণ বাড়ানোও সময়ের দাবি।
আমরা যদি নদীদখল
ও দূষণমুক্ত করে ইলিশের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে পারি তাহলে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়ানো
সম্ভব। সেই সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে ইলিশ আহরণের নিষেধাজ্ঞাকাল নির্ধারণ
করতে হবে। ইলিশ শুধু দেশেই নয়, রপ্তানি বাজারেও এর চাহিদা রয়েছে। আমরা এক্ষেত্রে ইলিশের
উৎপাদন বাড়াতে নতুন নতুন গবেষণার দিকেও সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নজর দিতে
বলি। দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে সরকার মৎস্যসম্পদের
ওপর যে গুরুত্ব দিয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় ইলিশসহ মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা,
উৎপাদন বৃদ্ধি ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। ইলিশসহ আমাদের মৎস্যসম্পদ ঘিরে
আজ সম্ভাবনার বহুমুখী দরজা উন্মুক্ত। সেজন্য চাই সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা এবং যথাযথ
বাস্তবায়ন। যাতে মৎস্য আহরণকারীদেরও স্বার্থ সংরক্ষণ হবে।