মূল্যস্ফীতি
আবু আহমেদ
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪ ১৪:৫১ পিএম
এবার পবিত্র মাহে
রমজান শুরু হয়েছে ১২ মার্চ। ওই দিন সংবাদমাধ্যমে বিশেষ করে পত্রিকা ও তাদের অনলাইন
সংস্করণে মুখ্য খবর হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে রমজানে বাজারদর, নিত্যপণ্যের দাম, চাপে-তাপে
ভোক্তা, রোজার বাজারে আরও অস্বস্তি ইত্যাদি শিরোনাম-উপশিরোনাম সংবাদ প্রতিবেদন। ‘বাজারের
বোঝা নিয়ে রোজা শুরু’ শিরোনামে ওই দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে
যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে প্রতীয়মান হয়, রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার যে কঠোর অবস্থানের
কথা বলে বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করেছিল, কার্যত এর সুফল মেলেনি। ১৩ মার্চ প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ ‘রাতের ব্যবধানে দাম বাড়ল কেজিতে ২০-১০০ টাকা’ শিরোনামে প্রতিবেদনে যে তথ্য
উঠে এসেছে তা যেন অসাধু ব্যবসায়ীদের তুঘলকি কাণ্ডেরই আরেক দফা উৎকট নজির। দ্রব্যমূল্য
নিয়ন্ত্রণে কাজ করার জন্য নির্দেশনা আইজিপিরÑএ খবরও প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত
হয়েছে একই তারিখে।
১৩ মার্চ প্রতিদিনের
বাংলাদেশ-এ নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি এবং রাজধানীসহ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বাজারের
চিত্রও উঠে এসেছে। আমরা জানি, ইফতারে খেজুর রোজাদারদের কাছে অন্যতম অনুষঙ্গ। সাধারণ
মানের খেজুরের দাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এক আদেশে নির্ধারণ করে দিয়েছে। খেজুরের
আমদানি মূল্য, আরোপিত শুল্ক ও অন্যান্য কর এবং আমদানিকারকের সার্বিক খরচ বিশ্লেষণক্রমে
প্রতি কেজি খেজুরের মানভিত্তিক যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হলেও নির্ধারিত দামের চেয়ে
অনেক বেশিতে ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে। অন্য একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সরকারি
সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তালিকা ধরে ১৫টি পণ্যের মূল্য বিশ্লেষণে
উঠে এসেছে, গত রমজানের তুলনায় এবার অন্তত ১০টি পণ্যের দাম অনেক বেশি।
আমরা জানি, টিসিবিসহ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর মাংস, ডিম, দুধ, চিনি, ভোজ্য তেল, পেঁয়াজ ইত্যিাদি বিক্রয়
কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তা সিন্ধুর মাঝে বিন্দুর মতো। দেশে মূল্যস্ফীতির
প্রবণতা বিশ্লেষণে ইতোমধ্যে অর্থনীতির বিশ্লেষক কিংবা অর্থনীতিবিদরা তাদের নানা রকম
পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন; যা সংবাদমাধ্যমে ইতোমধ্যে বহুবার উঠে এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন
হচ্ছে, তাদের এ পর্যবেক্ষণ সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলো কতটা আমলে নেয়?
খুব দূরের ঘটনা
নয়, ভোক্তা ক্রয়সাধ্য অনুযায়ী টাকা নিয়ে বাজারে গিয়ে ব্যাগ ভরে চাহিদার নিরিখে নিত্যপণ্য
কিনে এনেছেন; আর এখন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে গিয়েও পকেট ভর্তি বাজার নিয়ে আসা যায় না।
তা ছাড়া আয়বৈষম্য এতটাই প্রকট হয়ে উঠছে যে, বাজারে যাওয়ার আগে মোট জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য
অংশ চাহিদায় কাটছাঁট করেও ন্যূনতম পণ্য কিনতে পারছেন না ক্রয়সাধ্যের বাইরে থাকার কারণে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধকল আমাদের দীর্ঘদিন ধরে সইতে হচ্ছে। এর মধ্যে সম্প্রতি বিদ্যুতের
দাম আরও এক দফা বেড়েছে, বাড়তে পারে গ্যাস-পানির দামও। এ উপসর্গগুলো মরার ওপর খাঁড়ার
ঘায়ের শামিল এবং মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেওয়ার হেতু সৃষ্টি করে। অস্বীকার করার উপায়
নেই, বিদ্যমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে বাজারসহ জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে অভিঘাত লেগেছে
এবং আমরাও এর বাইরে নই। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের এখানে সুযোগসন্ধানীরা রীতিমতো
ওত পেতে থাকে এবং যেকোনো সুযোগে নিজেদের আখের গোছাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এমন বিস্তর নজির
আমাদের সামনে আছে। আমাদের বাজারের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট শব্দটি বহুলপ্রচলিত। এর অস্তিত্বের
কথা মন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকেই অকপটে স্বীকার করেছেন। তাদের
কেউ কেউ এও বলেছেন, সিন্ডিকেট কারসাজি করে ভোক্তার পকেট কেটে চলেছে। দায়িত্বশীলদের
এসব কথা শুনলে বিস্ময় তো জাগেই, ক্ষুব্ধও করে তোলে। প্রশ্ন হচ্ছে, সিন্ডিকেটের
হোতাদের হাত কি আইনের হাতের চেয়েও লম্বা? কেন তাদের চিহ্নিত করে অতিমুনাফার লালসার
লাগাম টেনে যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত করা যায় নাÑএ প্রশ্ন ফিরে ফিরে সামনে আসে। সরকারের
তরফে বারবারই বলা হচ্ছে, নিত্যপণ্যের কোনো ঘাটতি নেই, সংকট নেই সরবরাহব্যবস্থায় এবং
মজুদ যে পরিমাণ আছে তাতে চাহিদার নিরিখে জোগান ঠিক রাখা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু এ ভাষ্যের
সঙ্গে বাজারচিত্রের বড় বেশি অমিল। যদি সরকারের ভাষ্য আমরা মেনে নিই, তাহলে এ প্রশ্নও
করতে হয়Ñসবকিছুই এত নির্বিঘ্ন থাকা সত্ত্বেও বাজারের চাপে-তাপে ভোক্তা কেন নাকাল?
নিম্ন আয়ের মানুষ
তো বটেই, জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশেরই মূল্যস্ফীতির অভিঘাত সহ্য করা দুরূহ হয়ে
পড়েছে। শহরাঞ্চলে ও গ্রামাঞ্চলে মানুষের জীবনযাপনে মূল্যস্ফীতির তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণে
অবস্থা যে কতটা টালমাটাল তা-ও সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাজারে সুশাসনের বড় অভাব রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিক চার মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকার এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচন উত্তর পঞ্চমবারের মতো তারা সরকার গঠন করে সাফল্য দৃশ্যমান করতে পারেনি। আমরা
দেখছি, প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশের সরকারই উচ্চ মূল্যস্ফীতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে
সক্ষম হয়েছে। আমাদের বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি এমনিতেই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের
যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার চেয়েও কম। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ঋণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে
মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার অবকাশ কতটা আছে, প্রশ্ন আছে এ নিয়েও। আমরা এও দেখছি,
আমদানি করতে হয় না এমন পণ্যের দামও কোনো কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে কিংবা
যায় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফে নানা রকম প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়, সংবাদমাধ্যমে
অতিমুনাফখোর অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির চিত্র উঠে আাসে কিন্তু প্রতিবিধান নিশ্চিত
হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? এ কেনর উত্তর কঠিন কিছু নয়। বাজারের নাটাই যাদের হাতে তারা
তাদের ইচ্ছামাফিক ভোক্তার পকেট কেটে নিজেদের উদর পূর্তি করে এবং এ অন্যায়ের দৃষ্টান্তযোগ্য
প্রতিকার হয় না বিধায়ই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না।
আমরা বারবার বলছি,
বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর হোন। সরকার ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোও তাদের অনমনীয় অবস্থানের
কথা বলছে কিন্তু কোনো সুফল মেলে না। স্পষ্টতই মনে করি, মূল্যস্ফীতির অভিঘাত বন্ধে
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজির পথ রুদ্ধের পাশাপাশি সিন্ডিকেটের
হোতাদের চিহ্নিত করে নির্মোহ আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আড়তদার-মজুদদারসহ বাজারের
কলকাঠি যারা নাড়ে তাদের ব্যাপারে কোনো অনুকম্পা দেখানোর অবকাশ নেই। এসব নিয়ে কথা হয়েছে
বিস্তর কিন্তু কাজের কাজ কতটা কী হয়েছে সরকারের দায়িত্বশীলদের এ আত্মজিজ্ঞাসা খুব প্রয়োজন।
এও বিশ্বাস করি, ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটলে অবস্থা বদলাতে বাধ্য। একই সঙ্গে সেবা খাত
বিশেষ করে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল
করার আগে সাধারণ মানুষের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যুরোক্র্যাসি থেকে
শুরু করে সরকারি সব খাতের ব্যয়ে লাগাম টানতে হবে। চলমান বৈশ্বিক সংকট খুব সহসা কাটবে
বলে মনে হয় না। কিন্তু এর জন্য আমাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকা এবং অজুহাত দাঁড় করানোর
অবকাশ নেই।
আমাদের পলিসি তৈরিতেও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আগে নিজের ঘর ঠিক করতে হবে তারপর বিদেশিদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে। ব্যবসাবান্ধব নীতি কাগজে কলমে যথেষ্ট আছে কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। আমাদের দেশে বড় ব্যবসায়ীরা ভালো সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সেটিই যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া এখানে ঘন ঘন নীতি বদলও সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় তৈরি করে। অনিয়ম-দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার লাগাম টানতে হবে, দায়ীদের যথাযথ বিচার করতে হবে। চাঁদাবাজি চলছে ঘাটে ঘাটে। অসাধু পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির বিস্তর অভিযোগ আছে। চাঁদাবাজিই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় ব্যবসার অনুষঙ্গ। এ করণেও দেশে স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতা কিংবা অব্যবস্থার খেসারত সাধারণ মানুষ গুনবে কেন? জনজীবনে স্বস্তি নিশ্চিত করার দায় যাদের তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত হওয়াও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।