× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সাদি মহম্মদের স্বেচ্ছামৃত্যু

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন…’

মহিউদ্দিন খান মোহন

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪ ১৪:৪৬ পিএম

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন…’

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ কিংবা ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে’র মতো রবীন্দ্রসংগীত যার ভরাটকণ্ঠে অন্যরকম আবহ নিয়ে বাঙময় হয়ে উঠত, সেই চিরতরুণ কণ্ঠ আজ স্তব্ধ। আর কোনো দিন তিনি দর্শক-শ্রোতার সামনে খুলে ধরবেন না গানের ডালি। আর কোনো দিন আমরা শুনতে পাব না তার সুললিত কণ্ঠে কবিগুরুর লিখে যাওয়া গান। সেই শিল্পী সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহ আর নেই। এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সব চাওয়াপাওয়া, আশা-নিরাশার ঊর্ধ্বে চলে গেলেন তিনি। পেছনে রেখে গেলেন দীর্ঘ পথচলার দৃপ্ত পদচিহ্ন। এ দেশের সংগীতজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রসংগীতের অন্যতম পুরোধা সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহর কণ্ঠে ছিল জাদুর ছোঁয়া। তিনি যখন তন্ময় হয়ে গান গাইতেন দর্শক-শ্রোতা অন্যরকম আবেশে বিমোহিত হতো। রাষ্ট্র তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করেনি, নিশ্চয় তা খুব পরিতাপের। কতবার যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার গান শুনেছি! রেডিও কিংবা টেলিভিশনে তার প্রোগ্রাম থাকলে আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম কখন সুরের মায়াজাল ছড়িয়ে দেবেন ইথারে।

দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী সাদি মহম্মদ এ পৃথিবীতে ভ্রমণ শেষ করেছেন ১৩ মার্চ রাতে। নিজের সুরসাধনার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ এক রহস্যময় মৃত্যু! বেদনায় হৃদয় কুঁকড়ে যায়। কী এমন হতাশা ছিল তার, যেজন্য নিজহাতে জীবনের সমাপ্তি টানতে হলো? প্রিয় শিল্পী সাদি মহম্মদের মৃত্যুর খবর পেয়েই ফোন করলাম আমার আবাল্যবন্ধু সাদি মহম্মদের অত্যন্ত স্নেহভাজন শিল্পী শাফিককে। সাবেক ব্যাংকার শাফিকুর রহমান খান বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার সদস্য। ফোনে কথা বলতে পারছিলেন না। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, মায়ের মৃত্যুর পর নিদারুণ হতাশায় ভুগছিলেন সাদি। তার ওপর রয়েছে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হওয়ার মর্মযাতনা। সব মিলিয়ে চিরকুমার সাদি মহম্মদের জীবন জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল বোধহয়।

সাদি মহম্মদ শুধু একজন সংগীতশিল্পীই নন, তিনি শহীদ পরিবারের সন্তান। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি বাহিনীর দোসরদের হাতে প্রাণ হারান। সে কাহিনী একদিন শুনিয়েছিলেন সাদি মহম্মদ। কয়েক বছর আগে চ্যানেল আইয়ের সকালবেলার গানের অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। উপস্থাপিকার সঙ্গে আলাপচারিতার একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির কথা উঠলে নিজের জীবনের সেই ভয়ংকর স্মৃতি বর্ণনা করেন সাদি। বলছিলেন কী নিষ্ঠুরতায় তার বাবাকে খুন করেছিল প্রতিবেশী অবাঙালি মানুষটা। সাদি মহম্মদরা তখন ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকেন। স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ওই পরিবারটি টার্গেট হয়েছিল একই মহল্লার বিহারিদের। ২৫ মার্চ হানাদার পাক বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের পর যখন নিরস্ত্র বাঙালি ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিল, সাদির বাবা নিজের বাসায়ই ছিলেন পরিবার নিয়ে। মহল্লার সবাই সবার পরিচিত, এ ভরসায় তিনি অনেকের পরামর্শ সত্ত্বেও থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভাবতে পারেননি, এত বছরের প্রতিবেশী পরদিন সকালে হন্তারক হয়ে ঢুকবে তার বাসায়!

সাদি মহম্মদ বলেছিলেন, ভোরবেলায় প্রতিবেশী অবাঙালি লোকটি হাজির হয় ছোরা হাতে সাক্ষাৎ আজরাইল হয়ে। সাদির চোখের সামনে বাবার পিঠে সেই পাষণ্ড আমূল বসিয়ে দিয়েছিল তীক্ষ্ণধার ছোরা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল বিছানা, মেঝে। পাষণ্ডটা একটু সরে যেতেই সাদি বাবার পিঠ থেকে ছোরাটি টেনে বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমূল বসে যাওয়া ছোরা টেনে বের করা কিশোর সাদির পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। মৃত্যুপথযাত্রী বাবা বারবার বলছিলেন, ‘বাবা তুই চলে যা। না হলে ওরা তোকেও মেরে ফেলবে।’ নিজের জীবন বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত আহত বাবাকে ফেলে বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল সাদি মহম্মদকে। আর তার মা হায়েনাদের হাত থেকে নিজের জীবন ও ইজ্জত বাঁচাতে লাফিয়ে পড়েছিলেন দোতলার বারান্দা থেকে। তারপর যত দিন বেঁচে ছিলেন, স্বাধীনতার স্মারক হিসেবে পঙ্গুত্ব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। সেসব কথা বলতে বলতে সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। সজল চোখে দর্শকের কাছে দোয়া চান তার শহীদবাবার জন্য।

টিভির খবরে দেখলাম সাদি মহম্মদের মোহাম্মদপুরের বাড়িতে শোকার্ত স্বজন, সহশিল্পী শিক্ষার্থী ও সংগীতজগতের বড় বড় সব মানুষের ভিড়। কেউই তার এ অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। মৃত্যু সব সময়ই অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে পরিণত বয়সে, প্রাকৃতিক নিয়মে যখন কারও মৃত্যু হয়, মনকে প্রবোধ দেওয়া যায়। কিন্তু এমন মৃত্যু কি মেনে নেওয়া যায়? বন্ধু শাফিক বললেন, বছরখানেক আগে মায়ের মৃত্যুর পর থেকে সাদি মহম্মদ বিষণ্নতায় ভুগছিলেন। সংগীতের বাইরে মা-ই ছিলেন তার ধ্যানজ্ঞান। কিশোর বয়সে বাবাকে হারিয়ে মাকে অবলম্বন করে বেঁচেছিলেন সাদি। মায়ের মৃত্যু ছাড়াও আরেকটি বিষয় সাদিকে হতাশার সাগরপারে নিয়ে গিয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এত বড় একজন শিল্পী, যিনি রবীন্দ্রসংগীতে এনেছেন নতুন ডাইমেনশন তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান পেলেন না! যে তার ছাত্র হওয়ারও যোগ্য নয়, দেশের সংগীত ক্ষেত্রে যার কোনো অবদানই নেই এবং যার বিরুদ্ধে রয়েছে অনৈতিক ব্যবসার অভিযোগ, সেই কথিত শিল্পী যখন একুশে পদক লাভ করেন তখন সাদি মহম্মদরা হতাশ না হয়ে কি পারেন? হয়তো এবার তিনি ‘মরণোত্তর’ কোনো পদক পাবেন। কর্তৃপক্ষের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, দয়া করে তাকে এ অপমান করবেন না।

সাদি মহম্মদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো আলাপপরিচয় ছিল না। গান শুনেই আমি তার ভক্ত। বন্ধু শাফিক একবার সাদি সাহেবের পক্ষ থেকে একটি অনুরোধ নিয়ে এসেছিল। আমি তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব। সাদি সাহেব এবং তার দল বিদেশ যাবে। কী একটা ঝামেলা হয়েছিল। শাফিককে বলেছিলেন, তোমার বন্ধুকে বলো কাজটা করে দিতে। ফোন করেছিলাম নির্দিষ্ট কর্মকর্তাকে। বলেছিলাম, কত চোরাকারবারি, আদম পাচারকারী নির্বিঘ্নে চলে যায় বিদেশে, আর আপনারা আটকে রাখেন সাদি মহম্মদের মতো প্রথিতযশা মানুষকে! ভদ্রলোক লজ্জিত হয়েছিলেন। মুহূর্তেই ঝামেলা মিটি গিয়েছিল।

কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের সঙ্গে সরাসরি দেখা বা কথা না হলেও তারা নিকটাত্মীয়তে পরিণত হন। সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহ আমার তেমনই একজন আত্মার আত্মীয়। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।


  • সাংবাদিক ও কলাম লেখক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা