× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

উৎপাদনে বাংলাদেশ হতে পারে রোল মডেল

আমিরুল আবেদিন

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২২ ১৫:৪৮ পিএম

আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০১:৫৫ এএম

উৎপাদনে বাংলাদেশ হতে পারে রোল মডেল

যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার দিকে সারা পৃথিবীর মনোযোগ। এমন সংকটের কারণ নিয়েও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অভাব নেই। সচরাচর যুক্তরাজ্যের মানুষ রাজনীতি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না। এবার দৃশ্যপট বদলে গেছে। সবার একই প্রশ্ন, নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক কি পারবেন সংকট সামাল দিতে? করোনাকালে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে দেশটির মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক। শিল্পবিপ্লব যে দেশটিতে শুরু হয়েছিল, সে দেশটির এমন অবস্থায় আতঙ্কিত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে অর্থনীতিবিদরা এমন শঙ্কাকে যৌক্তিক বলে মানতে নারাজ। আপাতত ব্রিটেনের এই অর্থনৈতিক মন্দা শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক সরবরাহ ঘাটতির ওপর চাপিয়ে দিলে চলবে না। অন্তত আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষকদের দাবি, বিগত কয়েক দশকে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে কিছু জট কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, যা রাজনীতিবিদরা শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন ব্রিটেন যদি অর্থায়ন, স্টক মার্কেট কিংবা ব্যাংকিং খাত থেকে মনোযোগ সরিয়ে উৎপাদননির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে, তাহলে বিদ্যমান সংকট সহজেই মোকাবিলা করতে পারবে। আসন্ন সংকটের কথা মাথায় রেখে উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।

কিন্তু চলতি বছর যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক স্থবিরতার পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে কিছুটা থমকে দাঁড়াতে হয়। বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি দেশটিতে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে প্রকৃত আয় কমতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ১৫ বছর আগেও ব্রিটেনের প্রকৃত আয় এতটা কমেনি যতটা এই বছর কমেছে। আগামী বছরে তা আরও কমবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। ফলে পশ্চিম ইউরোপে যত দেশ আছে, তার মধ্যে ব্রিটেন জীবনযাত্রার মান ও প্রকৃত আয়ের দিকে অনেক পিছিয়ে গেছে। অবশ্য যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির স্থবিরতা আজকের নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই দেশটিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার আশানুরূপভাবে বাড়েনি। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বেহাল দশা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে মার্গারেট থ্যাচার সংকট সামলাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার প্রচেষ্টায় জাতীয় অর্থনীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে সুযোগ্য ও দক্ষ রাজনীতিবিদের ভূমিকা যে কতটা অপরিহার্য, তা মার্গারেট থ্যাচারকে দেখলে বোঝা যায়। তিনি প্রথমে বাজারের ওপর সব ধরনের আইনি নিয়ন্ত্রণ বা বাধা তুলে দেন এবং ইউনিয়নগুলো ভেঙে ফেলেন। উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেওয়ার ফলে ব্রিটিশ অর্থনীতিতে আবার স্বর্ণযুগ ফিরে আসে। 

থ্যাচার মূলত নিওলিবারিজম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার নীতি নির্ধারণ করেছিলেন। এসব নীতির ভালো-মন্দ দু’ধরনের প্রভাবই ছিল। ১৯৯০ সালেরে পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। আর এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রাণকেন্দ্র তখন লন্ডন। এককালে বিশ্বের শিল্পকারখানা বলে পরিচিত শহরটি একুশ শতকে বিশ্বের ব্যাংকার বলে আখ্যায়িত হতে শুরু করে। ব্রিটেন উৎপাদনবিমুখ হতে শুরু করে। স্টক মার্কেট, করপোরেট ব্যবসা, ব্যাংকিং খাতকে ঘিরেই ব্রিটেন (বলা যেতে পারে লন্ডন) তাদের অর্থনীতিবিষয়ক পরিকল্পনা নিতে শুরু করে। কিন্তু লম্বা রেসের হিসেবে এমন নীতি-পরিকল্পনা মোটেও ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না। ফল যা হওয়ার তাই হলো, ২০০৮ সালেই ফের ছন্দপতন। অনেক দিন পর্যন্ত ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় একটি ভুল করে বসেন দেশটির নীতিনির্ধারকরা। ওই সময়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে শুরু করে। নীতিনির্ধারকরা ঘাটতি পূরণের জন্য ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তাদের নির্ভরতার কেন্দ্র হয়ে উঠল ব্যাংক। অথচ তাদের প্রয়োজন ছিল উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা জাতীয় চাহিদা পূরণের জন্য নীতি নির্ধারণ করা। এমন ভুল পরিকল্পনার ফলাফল ছিল ভয়ংকর। টানা ছয় বছরে প্রকৃত আয় হ্রাস পেতে থাকে। নীতিনির্ধারকদের কাছে এই ভুতুড়ে পরিস্থিতিতে করণীয় কী হতে পারে তা স্পষ্ট ছিল না। তাই তারা দোষ চাপানোর পথকেই সমাধান হিসেবে বেছে নেন। দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে দায়ী করে তারা ব্রেক্সিটের দিকে ঝুঁকে পড়েন। 

গত ত্রিশ বছরে ব্রিটেনের নীতিনির্ধারকদের কাছে শিল্পের চাইতে ফিন্যান্সের মূল্য ছিল বেশি। তাই প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বিনিয়োগের বদলে তারা কৃচ্ছ্রসাধনের দিকেই বেশি মনোযোগী হন। অপরদিকে ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ভোটাররা সীমাবদ্ধ এবং দরিদ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বেছে  নেন। ওই সময়ে অর্থনীতিবিদরা যেমনটি ভেবেছিলেন, তেমনটাই হয়েছে। যুক্তরাজ্যে উৎপাদন কমেছে এবং বাড়ছে বেকারত্ব। অবশ্য ব্রিটিশ গণমাধ্যম বেকারত্বের একটি নতুন কারণ বেশ ফলাও করে প্রচার করছে। তারা বলছে, কর্মক্ষেত্রে যন্ত্র আর রোবটের ব্যবহার বাড়ায় এমনটা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর উল্টোচিত্র দেখতে পাই। একটি সমীক্ষা জানায়, ২০০৩ থেকে ২০১৮, এই ১৫ বছরে অটোমেটিক কার ওয়াশের পরিমাণ কমেছে ৫০ শতাংশ। অপরদিকে মানুষের হাতে গাড়ি সাফসুতরো করার পরিমাণ বেড়েছে ৫০ শতাংশ। ইকোনমিস্ট পত্রিকার লেখক ডুনকান ওয়েলডন এ ব্যাপারটি নিয়ে একটু রসিকতা করতেও ছাড়েননি। তিনি বলেছেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে মানুষই রোবটের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে।’ অর্থাৎ প্রযুক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে বেকারত্ব কিংবা মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। একসময় রাজনীতির সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ত না হলেও মানুষ ঠিকই বিষয়টি বুঝতে পেরেছে। উৎপাদনমুখী পরিকল্পনা নেই বলেই তো পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান গড়ে উঠছে না।

অধিকাংশ পরিসংখ্যানেই দেখা গেছে, উৎপাদনের দিক থেকে পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্রিটেন অনেকটাই পিছিয়ে। অগত্যা, শিল্পবিপ্লব শুরু করা প্রথম দেশটি সবার প্রথমে শিল্পবিমুখ হয়ে পড়েছে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশটির পরিসংখ্যান হতাশাজনক। একইসঙ্গে এসব পরিসংখ্যান আতঙ্কজনক। সবচেয়ে বড় কথা, এককালে যে দেশটি সারা বিশ্বেই বাণিজ্য প্রসারে উৎসাহী ছিল তারাই কি না বাইরের দেশের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য ভোট কর্মসূচি আয়োজন করেছে। ব্রেক্সিটের পরপরই অভিবাসন, রপ্তানি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ব্যাপক হারে কমতে শুরু করে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নীতিনির্ধারকদের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। 

এই আলোচনার শুরুতেই ব্রিটেনের অর্থনীতির মধ্যে থাকা বিশৃঙ্খলার কথা বলা হয়েছে। সেই বিশৃঙ্খলাটি যে উৎপাদনবিমুখতা তা ঘটা করে বোঝানোর কিছু নেই। হয়তো এখনও ব্রিটেনের রাজনীতিবিদরা এই বিশৃঙ্খলাটিকে পুরোপুরি শনাক্ত করতে পারেননি। বিশেষত লিজ ট্রাসের নির্বাচনি প্রচারণার সময়েও বিষয়টি মোটা দাগে আমাদের সামনে আসে। নির্বাচনে জয়ের জন্য তিনি কর কমানোর আশ্বাস দেন। কিন্তু এসব আশ্বাস তিনি কীভাবে পূরণ করবেন তা কখনও স্পষ্ট করেননি। এমনকি দেশের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে তিনি আদৌ চিন্তিত কি না তাও জানা যায়নি। রাজনীতিবিদদের মুখে শুধু ব্রিটেনের সংকট শব্দটিই বারবার পাওয়া গেছে। যেন এই সংকট তারা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বারবার মুদ্রাস্ফীতিতে জোর দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে তিনি কতটা সফল হবেন তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। অনেকে বলছেন তাকে হয়তো ফের ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বারস্থ হতে হবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ব্রেক্সিটের অন্যতম উদ্যোক্তা তিনি। তাই আদৌ তিনি এমন কিছু করবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। অর্থনীতিবিদ মেট ক্লেইন বলেছিলেন, ‘ইংল্যান্ডের থেকে লন্ডন শহরটি সরিয়ে নাও, দেখবে ইংল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ।’ আপাতদৃষ্টে মেট ক্লেইনের উক্তিটিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এদিকে সমগ্র পৃথিবী ব্রিটেনের দিকে তাকিয়ে।

অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কা করছে এমন দেশগুলোও ব্রিটেনের পরিকল্পনার ফলাফল দেখার অপেক্ষায়। এমন সময়ে ফ্রান্সেও ধীরে ধীরে জনরোষ তৈরি হচ্ছে। সেখানেও মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার মান ক্রমেই কমতে শুরু করেছে। তাই ব্রিটেনের অর্থনৈতিক মন্দা শুধু ব্রিটেনের নয়, সারা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো উৎপাদনবিমুখ হওয়ায় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বিষয়টিকেই ধরা যাক। তাদের জাতীয় আয়ের বিশাল একটি অংশ পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অর্থাৎ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশকেই উৎপাদনমুখী পরিকল্পনায় জোর দিতে হবে। এরই মধ্যে বিশেষজ্ঞরা খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত দিয়ে চলেছেন। এমন সময়ে উৎপাদন বাড়ানো ব্যতীত আশু সংকট মোকাবিলার কোনো বিকল্প নেই। এখন দেখার বিষয়, এই সামান্য বিষয়টিকে নীতি-নির্ধারকরা শনাক্ত করতে পারেন কি না। তবে পশ্চিমে রক্ষণশীলদের উত্থান এবং নেতৃত্বশূন্যতার পরিস্থিতি দেখে সহসাই এমন উপলব্ধির আশা করা যাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের নীতিনির্ধারকরা দেরিতে হলেও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন, যা কিছুটা হলেও আশা জোগায়। যদি সংকট সামাল দেওয়ার মতো সঠিক উৎপাদনমুখর পরিকল্পনা নেওয়া যায়, তাহলে পশ্চিমাদের জন্যও বাংলাদেশ একটি রোলমডেল হয়ে উঠতে পারবে। 


লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা