আগামীর বাংলাদেশ
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ১১ মার্চ ২০২৪ ১৩:১৪ পিএম
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
স্বাধীনতার বায়ান্ন
বছর অতিক্রান্তে অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতি সন্তোষজনক পর্যায়ে- এ কথা অসত্য নয়, কিন্তু
অসন্তোষের কথাও কম নয়। আমাদের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির অগ্রগতির বিষয়ে ঝুঁকে গেছে বলেই
প্রতীয়মান। অর্থনীতির নানা খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রয়েছে।
কিন্তু অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। গত পাঁচ দশকে অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিভিন্ন চড়াই উতড়ে আমাদের সামনে এগোতে হয়েছে। সমস্যা হলো, আমাদের
অর্থনীতি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে- এমনটি বলা যাবে না। আমাদের সামনে উচ্চ-মধ্যম
আয়ের দেশের তালিকাভুক্ত হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এই লক্ষ্যের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে
জিইয়ে আছে অর্থনৈতিক কাঠামোর নানাবিধ সংকট। অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের
সামনে আর্থিক খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা তৈরির মূল চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
আমরা জানি, আমাদের
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও টলোমলো হয়ে রয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতেও।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক কাঠামোর স্থিতিশীলতা কিছুটা হলেও ফিরেছে।
সংকটময় এই পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতে বিদ্যমান সংকট-সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এ কথা সত্য, স্বল্প সময়ে আমরা আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনতে পারব না। কিন্তু উচ্চ-মধ্যম
আয়ের দেশের কাতারভুক্ত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনের পথে জিইয়ে থাকা প্রতিবন্ধকতার দ্রুত নিরসন
করার চেষ্টা করতে হবে। চলমান বৈশ্বিক সংকটে আর্থিক খাতের প্রস্তুতি থাকা জরুরি। আমাদের
অর্থনীতি লক্ষ্যের ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছে। এই ক্রান্তিলগ্নের গুরুত্ব অনুধাবন করে
আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখা জরুরি।
আর্থিক খাতে বিদ্যমান
সংকটের মধ্যে মূল্যস্ফীতি, টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট,
ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, হুন্ডি, মুদ্রা পাচার, শেয়ারবাজার দুর্নীতি, ঋণখেলাপ,
ঋণ অবলোপন বড় সমস্যা। সম্প্রতি বেকারত্বও আমাদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে
কর্মক্ষেত্রের অভাব থাকায় তরুণরাও বিদেশমুখী হচ্ছে। পাশাপাশি মানুষের আয়ের সংস্থানও
সংকুচিত হয়ে আসছে। আর্থিক বৈষম্য ক্রমেই বেড়ে চলছে। আয়ের ও সম্পদের বৈষম্য প্রকটভাবে
দৃশ্যমান। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজের ওপর। অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বৈষম্য জিইয়ে
থাকলে সামষ্টিক উন্নতি হলেও সাধারণ মানুষ এর সুফলভোগী হতে পারে না। বিদ্যমান বাস্তবতায়
অর্থনীতিতে বিদ্যমান সংকট সমাধানের দিকে শ্যেনদৃষ্টি রাখা জরুরি। আর্থিক খাতের সংকটগুলোকে
যদি কয়েকটি ভাগে বিচার করতে যাই, তাহলে প্রথমেই আসে সুশাসনের অভাবের প্রসঙ্গ। আর্থিক
খাতে সুশাসনের অভাব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ইতোমধ্যে কম হয়নি। এই সুশাসনের অভাবের পেছনে
রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বিরূপ প্রভাব ফেলে।
ব্যাংক খাতে সুশাসনের
অভাব থাকায় ব্যাংকের পরিচালক কিংবা সংশ্লিষ্ট অনেকেই নানা সুযোগে নয়ছয় করেন। ব্যাংক
পরিচালনার নীতিমালা তারা যথাযথভাবে অনুসরণ করেন না, এমন অভিযোগও রয়েছে। এ খাতে শৃঙ্খলার
অভাবের চিত্র সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের ব্যাংকেই বিদ্যমান। জবাবদিহি না থাকায় নিয়োগপ্রক্রিয়া
থেকে শুরু করে ব্যাংকিং কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা থাকে না। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে
যারা আছেন, তারা যেন নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করেন না। ব্যাংক শেষ পর্যন্ত যেন তাদের নিজস্ব
সম্পত্তি হয়ে উঠেছে। ব্যাংক চলছে আর্থিক নিয়মের মধ্যে। আমরা দেখছি রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক
প্রভাব আর্থিক নিয়মের পথ অনেকাংশে রুদ্ধ করে রেখেছে। ব্যাংক তার কার্যক্রম পরিচালনার
ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঞ্চয় কিংবা আমানতের ওপরও নির্ভর করে। যদি গ্রাহক না থাকে তাহলে
ব্যাংকে তারল্য সংকট বাড়বে এবং সুষ্ঠু কার্যক্রম ব্যাহত হবে। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতেও
এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে আরও বাড়াতে হবে মনোযোগ।
আমরা দেখছি, আর্থিক
খাতে বিভিন্ন সময় অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার
পর সমালোচনাও হয়। কিন্তু তাদের আইনের আওতায় এনে প্রতিবিধান নিশ্চিত করা হয় না অনেক
ক্ষেত্রেই। অভিযোগ আছে, ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব খাটিয়ে অনেকে
ঋণ নেয়। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক চাপে সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব
পালন করতে পারেন নাÑ এ অভিযোগও পুরোনো। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে
না পারায় ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজির পরিমাণ, তফসিলিকরণ,
সিঙ্গেল এক্সপোজার লিমিট, ঋণের শ্রেণিকরণ, সাব-স্ট্যান্ডার্ড, মন্দ ঋণ, খেলাপি ঋণসহ
নানা সমস্যার সমাধান বা চ্যালেঞ্জ ব্যাংক খাত সামাল দিতে পারছে না সুশাসনের অভাবে।
দুর্নীতি ও ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর অদক্ষতা-দুর্বলতা
সংগত কারণেই উঠে আসে। দেশে আর্থিক খাতে তদারকির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ
কমিশন, বিটিআরসির মতো নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো শক্ত অবস্থান নিয়ে এবং স্বাধীনভাবে
কাজ করতে পারছে বলে মনে হয় না। উল্লেখ্য, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কর্মকর্তারা রাজনীতি
ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত নন।
সার্বিকভাবে আর্থিক
খাতে সুশাসন অর্থাৎ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। এই সমস্যা শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই
নয়। আমরা দেখছি, প্রাইভেট সেক্টরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত
করছে না। এর বড় দৃষ্টান্ত আমাদের বাজারব্যবস্থা। আমাদের বাজার অনিয়ন্ত্রিত। মূল্যস্ফীতি
ক্রমেই বাড়ছে। সিংহভাগ মানুষের আয়ের সংস্থান কমছে। বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কাজ
দুরূহÑ এমনটি বলা যাবে না। সদিচ্ছা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার নিয়মনীতি অনুসরণ করলে তা
সহজেই করা যাবে। আমাদের সামনে এর উদাহরণ যে নেই এমনও নয়। আমরা জানি, শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া
হওয়ার পর আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আবার সুসংগঠিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কা থেকে
বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন দাঁড়ায়, আমরা কেন পারছি না। উল্লেখ্য,
আর্থিক খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে করণীয় কাজগুলো, সেখানে কিন্তু কোনো হস্তক্ষেপ করা
হয়নি। কোনো রকম রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে পড়েনি। তারা ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছে। বিভিন্ন
জায়গায় ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে কন্ট্রোল করেছে। ব্যাংকগুলোকে ঠিকমতো পুঁজি গঠন করার জন্য
যে নির্দেশনাগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো পরিপালন করা হয়েছে। এজন্যই তারা সামনের দিকে
এগিয়ে গেছে। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে
হবে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, সরকারি সম্পদ ও অর্থের অপচয় রোধ করা জরুরি।
নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নীতিমালা যত্নের সঙ্গে পরিপালন করতে হবে।
আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনা
দূর করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। আমরা দেখছি, সুদের হার এখনও বাজারমুখী করা হয়নি। ডলারের
বিপরীতে টাকার মূল্যমান অর্থাৎ বিনিময় হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান।
এজন্য সরকার ইতোমধ্যে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও উন্নতির চিহ্ন দৃশ্যমান নয়। আর্থিক
ব্যবস্থাপনা জোরদারকরণে ব্যাংকিং খাতে সংস্কার জরুরি। খেলাপি ঋণ ও অবলোপন ঋণের বিষয়টি
নিয়ে নতুন করে ভাবা মোটেও কঠিন কিছু নয়। আর্থিক খাতের সম্প্রসারণও জরুরি। আর্থিক খাতে
যেন ব্যাংকিং খাতের তারল্য প্রবাহ বাড়েÑ এমন সমন্বয়মূলক কাঠামো গড়তে হবে। প্রাইভেট
সেক্টর, বিশেষ করে বড় বড় শিল্প দরকার আছে, কিন্তু আমাদের ছোট-মাঝারি কুটির শিল্পকে
আরও উত্সাহ দিতে হবে। বাস্তবে এই খাতে ঋণসহায়তা বেশি নয়। আমাদের কর্মসংস্থান এবং উৎপাদনশীল
খাত হচ্ছে ছোট-মাঝারি শিল্প ও বাণিজ্য খাত। এগুলো পণ্য উৎপাদন করে। সেবা উৎপাদন করে।
এগুলো যদি বাড়ানো যেত, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি অনেক কমে যেত।
আর্থিক খাতে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের আগ্রহের অভাব রয়েছে। আগ্রহের অভাবের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে আমরা স্থায়ী টেকসই উন্নয়নের দিকে যেতে পারব না। সামষ্টিক অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে যাতে না পরে এ ব্যাপারে মনোযোগ গভীর করার পাশাপাশি নতুন কর্মকৌশলও অত্যন্ত জরুরি। সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এর অন্যতম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা। এ দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে এগোতে হবে। তবে শুধু কর্মপরিকল্পনা নিলেই হবে না, এর বাস্তবায়ন ও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।