× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নারীর অধিকার

বৈষম্যের ছায়ায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য

এলিনা খান

প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪ ১৩:০৭ পিএম

আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৪ ১৩:৩৪ পিএম

এলিনা খান

এলিনা খান

স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর অতিক্রান্তে বাংলাদেশে নারীর উন্নয়ন-অগ্রগতি নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয় সঙ্গত কারণেই। এবার ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিভিন্ন সেমিনারে ফের গুরুত্ব সহকারে এ বিষয়গুলো আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। নারীর অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তির জন্য অনেকেই সংগ্রাম করেছেন। তাদের সবার মানসপটে আগামী দিনের নারীর সম্ভাবনা ও জীবনের গতিবিধি সম্পর্কে ছিল সুনির্দিষ্ট ভাবনা ও প্রত্যাশা। এরই ধারাবাহিকতায় নারী নিজের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করেছে এবং করছে। তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিকতার মূলে সমাজের ভাবনা ও সময়ের বাঁকবদলেরও প্রভাব রয়েছে। একসময় নারীর অবরুদ্ধ জীবন সম্পর্কে যে ধারণা ছিল তা সময়ের পরিক্রমায় বদলেছে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ দৃশ্যমান। অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতে নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও মেধার পরিচয়ও নতুন কিছু নয়। কিন্তু নারীর নিরাপত্তা আজও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দৃশ্যমান নয়। আমরা বলছি অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ প্রশংসনীয়; কিন্তু সেখানেও নারীর খণ্ডিত পরিচয় রয়ে গেছে।


নারীর নিরাপত্তা সংকট ভিন্নরূপ পেয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে। সংকট হয়ে উঠছে বহুমাত্রিক, বাড়ছে অপরাধ ও নারী নির্যাতনের হার। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এর ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রভাব দুই-ই আছে। তবে নারীর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বরাবরই উল্লেখ করার মতো। প্রায় তিন দশক আগে বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও যৌথ পরিবারে পুরুষতান্ত্রিকতার ফলে নারী এক ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হতো। পরে আইনের প্রতিপালন ও যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ কিংবা যৌতুকের মতো ভয়াবহ প্রথাও অনেকাংশে দূর করা গেছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় নারীর প্রতি সহিংসতা-নির্যাতন বহুমাত্রিক রূপ লাভ করেছে। সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে নারী প্রায়ই প্রতারণার শিকার হচ্ছে। আমরা দেখেছি, করোনা মহামারিকালে ৯৯৯-এর মতো জরুরি সেবায় নারী গৃহনির্যাতনের শিকার হয়ে অভিযোগ করেছে। শুধু তাই নয়, করোনা দুর্যোগে সমাজমাধ্যমে নারীকে নানাভাবে হেয় করা এবং ট্রলের শিকারও হতে হয়েছে। এখনও তা বন্ধ হয়নি যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। অধিকারের পূর্ণতার জন্য সাম্যের আলো অত্যন্ত জরুরি। বৈষম্যের ছায়ায় বিকাশের আশা দুরাশার নামান্তর!

নারী নির্যাতনের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে। সমাজে মানুষের জীবনের পরিবর্তনের ফলে নির্যাতনের মাত্রাগুলো রূপান্তরিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি যে ফাঁকফোকর রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করে প্রায় প্রতিটি দেশেই নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে নারী প্রতারিত হয় এবং তাদের ওপর মানসিক নির্যাতনেরও নানা মাত্রা রয়েছে। আমরা দেখছি, সমাজমাধ্যমে ট্রেন্ডের স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক নারী ট্রলের শিকার হয়। আবার অনেকে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখে না। নারীর ক্ষেত্রে এসব ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব বেশি। ফলে অনেক সময় তাদের স্পর্শকাতর অনেক তথ্য অপকৌশলে হাতিয়ে ‘ব্ল্যাকমেইল’ও করা হয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বরাতে জানা গেছে, নানা অপকৌশলে নারীকে পর্নোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া হয়। সার্বিকভাবে সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয়ের নানামুখী চিত্র এবং অভিঘাত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। নৈতিক অবক্ষয়ের অভিঘাত লাগে নারীর জীবনে। এসব টুকরো টুকরো সংকট একসময় শৃঙ্খলের মতো নারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। সমাজের ভাবনা বদলের সুযোগ সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করে। তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায় সম্ভাবনার ওপর নির্ভর করে না বলেই আইনপ্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী এবং আইনের প্রতিবিধান নিশ্চিত করা গেলে সংকট পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে নিরসন করা সম্ভব।

গত তিন দশকে নারীশিক্ষার প্রসার ঘটেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং সাফল্য ঈর্ষণীয়। তবে সাক্ষরতা নারীর ক্ষমতায়নের মূল বিষয় নয়। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষার সচেতনতা ও দর্শনেরও প্রসার জরুরি। নারী শিক্ষিত হচ্ছেন বটে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সচেতন হচ্ছেন না। সচেতনতার অভাব থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পরনির্ভরশীল হতে হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তাদের অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। আর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সমাজমাধ্যম, যেখানে ব্যক্তিগত তথ্য থাকে। স্পর্শকাতর নানা তথ্য বাদেও অর্থনৈতিক লেনদেনের তথ্যও রয়েছে, সেগুলো অন্য কারও কাছে গেলে প্রতারণার শিকার হতে হয়। নারীও এ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সাক্ষরতা বাড়লে কেউ সচেতন হবে এমনটি নয়। একসময় গ্রামীণ সমাজে অনেক নারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না বটে কিন্তু তাদের বাস্তবিক জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ছিল অনেক। তাদের অভিভাবকত্বে অনেক সন্তান সুশিক্ষিত হয়েছে। বাস্তবিক জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় আর ভালোমন্দের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবেচনাবোধ জাগিয়ে তোলাও শিক্ষার অন্যতম মহৎ উদ্দেশ্য। ডিজিটাল যুগে এ সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে, এমনটি বললে ভুল হবে না।

স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। নারীর অধিকার নিশ্চিতকরণ ও নিরাপত্তা জোরদারকরণের দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি জোরালোভাবেই আমরা বলে থাকি। বরং নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে কেউ যেন বৈষম্যের শিকার না হন তেমন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবিই এ ক্ষেত্রে মুখ্য। নারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নিরিখে যোগ্য হয়ে উঠছে, যা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু শিক্ষার মূল আদর্শ থেকে অনেক নারী এখনও বিচ্যুত এবং এর দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কোনো পক্ষই এড়াতে পারে না। পেশাগত কারণে অনেক নারীর সঙ্গেই আমার আলাপ হয়। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নারী আজও তালাক শব্দে উদ্বেগে ভোগে। ওই নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হলেও সমাজে তার অবস্থানের বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত থাকে। তার ভাবনায় ন্যায়বিচার পাওয়া আর মুখ্য থাকে না। বরং সামাজিক পর্যায়ে ‘তালাকপ্রাপ্ত নারী’র তকমা লেগে যাওয়ার এক ধরনের ভয় কাজ করে তার মনে। এ ভয় প্রকাশ করতেও তার দ্বিধা থাকে না। এমনটি নারীর মানসিক অবস্থার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত তা বলা যাবে না।

সামাজিক এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নানা প্রতিবন্ধকতার ছায়া এখনও দৃশ্যমান এবং এর ফলে নারীরা আত্মোন্নয়নের সুযোগ পাচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু তাই নয়, সামাজিক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধকতা জিইয়ে থাকায় নারী প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তির কথা ভাবতে ভয় পায়, উদ্বেগে ভোগে। নারীর কাছে এখনও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, আর এর প্রভাব পড়ে তার মননে। এ অসহায়ত্বের সুযোগ পুরুষতন্ত্র সচেতন-অচেতন দুই ভাবেই নেয়। নারীকে এর শিকার হতে হয়। নারী নির্যাতন-নিপীড়ন বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলো নিরসনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ও সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি জানাই। অর্থনৈতিক মুক্তি তখনই সম্ভব যখন নারী মানসিকভাবে আত্মোপলব্ধি করতে পারবে, কিংবা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলে নারী নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তুলতে পারবে। অর্থনৈতিকভাবে সে অন্য কারও ওপর নির্ভর করবে না।

সম্প্রতি বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এর পেছনের বিদ্যমান বাস্তবতা বোঝা জরুরি। অনেক সময় পারিবারিক চাপে অনেক নারী বিয়ে করতে বাধ্য হয়। বিয়ের পর মতপার্থক্য দেখা গেলে বা অন্য অনেক কারণে নারী আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করে। অনেক সময় বিয়ে মেলবন্ধনের সম্পর্ক না হয়ে ভুল হিসেবে পরিণতি দৃশ্যমান হয়। দেশে নারী-পুরুষ সবার মধ্যে বিয়ে ধারণাটি স্পষ্ট নয়। নীতি-নৈতিকতা, সমাজ-সংস্কৃতির স্বরূপ সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। এমনকি নীতি-নৈতিকতার প্রতিপালন প্রসঙ্গে তাদের সচেতনতার অভাবও রয়েছে। এ অভাবের কারণেই বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাংস্কৃতিক দিকটি গুরুত্ব হারাচ্ছে।

নারীর নিরাপত্তা সংকটের ক্ষেত্রে কয়েকটি স্তরের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। প্রথমত. সমাজ কিছু সনাতন ধারণা নারীর গতিবিধি প্রসঙ্গে ধারণ করে। সামাজিক স্তরে নেতিবাচক ভাবনা নিরসনে পারিবারিক পর্যায়ে মূল্যবোধের চর্চা ও শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয়ত. ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা জরুরি। নারী যেন দুর্ভোগের শিকার না হয় তেমনভাবে আইনপ্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে হবে। নারীশিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি জরুরি হলো নারীকে সচেতন ও আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলা। নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির যে দাবি তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো এখনও প্রতিবন্ধকতা হিসেবে জিইয়ে আছে। আমরা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে অনেক এগিয়েছি এ কথা বলে থেমে থাকার অবকাশ নেই।

  • আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা