স্বাধীনতার মাস
মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪ ১৩:০৩ পিএম
মোস্তফা হোসেইন
৫৩ বছর আগে এ ভূখণ্ডে পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনীর সঙ্গে তাদের পোষ্য কতিপয় বাঙালি অর্থাৎ স্বজাতদ্রোহী দেশের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ, খুন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে অংশ নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর
পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এরাও আত্মসমর্পণ করেছে যৌথ বাহিনীর কাছে। দুর্ভাগ্যবশত এ
৫৩ বছরেও স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের গ্রহণযোগ্য কোনো তালিকা প্রকাশ হয়নি। নিকট
অতীতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন,
রাজাকারের তালিকার বিষয়ে দুই ভাগে কাজ করা হচ্ছে। একটি হলো সক্রিয়ভাবে যারা কাজ
করেছে তাদের নিয়ে এবং আরেকটি হচ্ছে জীবন বাঁচানোর জন্য যারা রাজাকার হিসেবে নাম
লিখিয়েছিল তাদের নিয়ে।
এ প্রক্রিয়াটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সহজেই মনে
আসছে ২০১৯ সালের মার্চের একটি সংবাদের কথা। ওই বছর ১৫ মার্চ একটি তালিকা প্রকাশ
করেছিল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছিল, সরকারি নথি অনুযায়ী এ তালিকা
করা হয়েছে। যাকে তিনি বলেছিলেন, প্রণয়ন নয় তারা তালিকাটি প্রকাশ করেছেন মাত্র।
রাজাকারের তালিকাটি প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল তখন। কারণ ওই তালিকায়
অন্তর্ভুক্ত রাজাকারের পাশে গ্যাজেটভুক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত সংগঠকদের নামও
দেখা গিয়েছিল। কোনো কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তালিকায়,
এই অভিযোগ উঠেছিল সংবাদমাধ্যমে। যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজে নিয়োজিত কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট
গোলাম আরিফ টিপুকেও রাজাকার বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সরকার
একুশে পদকে ভূষিত করে। তাকেই বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজাকার! শুধু রাজশাহী থেকেই গোলাম
আরিফ টিপুর মতো স্বাধীনতা আন্দোলনের পাঁচজন সৈনিককে রাজাকার বানানোর তথ্য প্রকাশ
হয়েছিল তখন।
বরিশাল সদর
উপজেলা অংশে ১০৭ জন রাজাকারের তালিকা করা হয়। তার মধ্যে বরিশাল মহানগরের শ্রীনাথ
চ্যাটার্জি লেনের বাসিন্দা ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সুধীর কুমার চক্রবর্তীর স্ত্রী
প্রয়াত ঊষা রানী চক্রবর্তী ও তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা তপন কুমার চক্রবর্তীর নাম
রয়েছে। তপন কুমার চক্রবর্তী প্রতিক্রিয়া
প্রকাশ করেছিলেন, ‘এটা খুবই লজ্জার বিষয়। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমার বাবা
মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে শহীদ হয়েছেন। অথচ এত বছর পর রাষ্ট্র আমাকে ও আমার
মাকে রাজাকারের খেতাব দিল। এ লজ্জা, দুঃখ কোথায় রাখব?’ তালিকায় তপন
কুমারের নামের পাশে একটি মামলা নম্বর রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো মামলার
কথা কখনেও শুনিনি। এ কাল্পনিক মামলার নম্বর কোথা থেকে আবিষ্কৃত হলো, কারা করল কিছুই বুঝতে
পারছি না।’ উল্লেখ্য, তপন কুমার চক্রবর্তীর মেয়ে মনীষা চক্রবর্তী পেশায় চিকিৎসক
এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব। মনীষা বলেন, ‘এটা
ভুল নয়, পরিকল্পিতভাবে করা হয়।’ ২০১৯ সালের ওই তালিকা বিষয়ে বলা
হয়েছিল, নথিপত্র দেখেই সেটা করা হয়েছিল। একইভাবে বলা হয়েছিল, ডিস্ট্রিক্ট কমিশনাররা
কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা প্রদান করেননি।
বিতর্কিত তালিকাটি হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। এ পাঁচ
বছরে তালিকা সংশোধন হওয়ার তথ্য জানা নেই। তবে ডিসেম্বর ও মার্চ এলে এ ধরনের
কথাবার্তা সরকারি মহল থেকে শোনা যায়। এবার শোনা যাচ্ছে নতুন কথা, যারা জীবন
বাঁচাতে রাজাকার হয়েছেন, তাদের আলাদা করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক
রাজাকারের সঙ্গে কথা বলেছি । প্রত্যেকেরই কথা, তারা জীবন বাঁচাতে রাজাকার বাহিনীতে
যোগ দিয়েছিলেন। একজন রাজাকারের প্রসঙ্গ বলতে পারি উদাহরণ হিসেবে। কুমিল্লা সদরের
রসুলপুর গ্রামের মোহন মিয়া (ছদ্মনাম) স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের সঙ্গে
পরামর্শক্রমে কয়েকজনকে নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সশস্ত্র যুদ্ধ থেকে
শুরু করে অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের মতো ঘটনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিলেন।
কিন্তু নভেম্বরের শেষ দিকে সঙ্গী রাজাকারদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে পারেন
পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হবে। বুদ্ধি করলেন তারা পালিয়ে যাবেন। সে অনুযায়ী রাতে
বাংকারে দায়িত্ব পালনকালে তিনজন পালিয়ে যান। আত্মসমর্পণ করেন মুক্তিবাহিনীর কাছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, নভেম্বরের আগে কিন্তু তারা পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করেননি। যখন
দেখেছেন পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হবে তখন পালিয়ে গেছেন এবং আত্মসমর্পণ করেছেন।
রাজাকারই বলবে তারা বাঁচার জন্য রাজাকার
বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তা হলে বাংলাদেশে রাজাকার খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
এত যাচাইবাছাইয়ের কষ্ট না করে ১৯৭২ সালে গঠিত থানা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি এবং
জেলা স্ক্রুটিনি কমিটির তালিকা সংগ্রহ করলে বড় একটি কাজ হয়ে যাবে। স্ক্রুটিনি
কমিটি সুপারিশকৃত মামলাগুলোর বরাত দিয়ে তালিকা তৈরি হলে কাজটি সহজতর হবে। সে ক্ষেত্রে
কিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত সব জেলায় দলিলপত্র সংরক্ষণ আছে কি না।
গ্যাজেটের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে কি না জানি না। পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে অনেক শান্তি
কমিটির সদস্যের নাম। সর্বশেষ সোর্স হিসেবে জীবিত রাজাকারদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে
পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নে কতটা আন্তরিকতা রয়েছে? আবার এখন
অনেকেই ভাবতে পারেন তার আত্মীয়স্বজনকে তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে তিনি বিরাগভাজন
হবেন কেন?
কাজটি করতে গেলে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে
সম্ভব হবে না। এর জন্য প্রয়োজন নির্মোহ গবেষকদের সহযোগিতা গ্রহণ। অনেক লেখক-গবেষক
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেন। ব্যক্তিপর্যায়ে কাজ করা এ মানুষগুলোর হাত দিয়ে কিছু
জেলার রাজাকারের তালিকা তৈরিও হয়েছে; যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য। বলছি না
যেসব তালিকা বইয়ে স্থান পেয়েছে, তা সবই যাচাইবাছাই ছাড়া গ্রহণ করা হোক। একটি
পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির জন্য প্রকাশিত তালিকা যাচাই করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। নতুন
করে তালিকা তৈরি করতেও তারা অদক্ষ অনেকের চেয়ে সফল হবেন। জানা মতে, গত তালিকা
প্রণয়নকালে তাদের কাউকেই যুক্ত করা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে ৫২ বছরে ৭ হাজারের
কাছাকাছি শিরোনামের বই বেরিয়েছে। তরুণরাও লিখছেন, গবেষণা করছেন তাদের সংখ্যাও কম
নয়। আমলানির্ভরতা কমিয়ে তরুণদের কাজে লাগালে সময় এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। বেঁচে
থাকা রাজাকারদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক স্মৃতিচারণা সংগ্রহও জরুরি। যদিও তাদের
অধিকাংশই সাক্ষাৎকারে উৎসাহী নন এবং শতভাগ সত্য তারা বলবেনও না। কিন্তু তাদের
বক্তব্য বিশ্লেষণ করে সত্য নির্ধারণে সহযোগিতা পাওয়া যাবে।
শেষ কথা হচ্ছে, রাজাকারের তালিকা হচ্ছে, হয়েছে- এমন কথা বহু আগে থেকেই শুনছি, এবার অন্তত দেখতে চাই রাজাকারের চূড়ান্ত তালিকা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অক্ষয় অধ্যায়। আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সড়ক ধরে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ী থাকি তাহলে দায়িত্বশীলতার বিষয়গুলো আমলে রাখতেই হবে।