পরিপার্শ্ব
রিতেষ কুমার বৈষ্ণব
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৪ ১৩:০০ পিএম
কালের বিবর্তনে
হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান গ্রামবাংলার অনেক ঐতিহ্যই। উড়ুন গাইন এরই একটি। একসময় গ্রামের
প্রতিটি বাড়িতে পাওয়া যেত উড়ুন গাইন। একনামে চিনে নেওয়া যেত কৃষিভিত্তিক সমাজের অন্যতম
গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটি। একসময় গ্রামীণ সমাজে উড়ুন গাইন ব্যতীত ধান থেকে চাল বের করা
ছিল কঠিন কাজ। ভোরবেলা উড়ুন গাইনের ধুপধাপ শব্দে সবার ঘুম ভাঙত। গ্রামবাংলার নারীরা
সকাল থেকেই উড়ুন গাইন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সারা দিনে আরও অনেক কাজ তো বাকি। তার
মধ্যে ধান থেকে চাল বের করার কাজটি প্রথম। ধান থেকে চাল বের হলে পড়ে রান্নার কাজ শুরু
হতো। শুধু ধানই নয় মশলা, চিড়া, পিঠার চালগুঁড়ো করার জন্যও উড়ুন গাইনের ব্যবহার ছিল
লক্ষণীয়। জীবিকার তাগিদে উড়ুন গাইনের মাধ্যমে অন্যের বাড়িতেও ধান ভানতেন অনেকেই। এক
থেকে দুজন নারী একসঙ্গে উড়ুন ও গাইনের মাধ্যমে কঠোর পরিশ্রম করে ধান থেকে চাল বের করে
দিতেন এবং এ থেকে জুটত সবার মুখের আহার। পাড়া প্রতিবেশীরা সম্মিলিতভাবে একে অপরকে ধান
ভানতে সহযোগিতা করতেন। উড়ুন গাইনের ব্যবহারে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার
সুযোগও ছিল বিস্তৃত। উড়ুন গাইন তৈরি করে হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করা হতো। বিশেষত গ্রামের
মেলাগুলোতে পাওয়া যেত উড়ুন গাইন। ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় মিলত তা।
কালের বিবর্তনে যান্ত্রিক যুগে মেশিনের মাধ্যমে প্রায় সব কাজ করে ফেলায় এই উড়ুন গাইনের ব্যবহার নেই বললেই চলে। এটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। উড়ুন গাইনের চাহিদা কমে যাওয়ায় উড়ুন গাইন তৈরির কারিগররাও জীবিকার তাগিদে বেছে নিচ্ছেন ভিন্ন রকম পেশা। উড়ুন গাইন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায় একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। একটা সময় এই এলাকার অনেকেই এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, কিন্ত বর্তমানে এর ব্যবহার এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় এ পেশার মানুষদের পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে অধিকাংশ কারিগর এ পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। ফসলি মৌসুমে এ পেশার সঙ্গে জড়িত অনেকেই কৃষিকাজ করেন। অতিরিক্ত আয় হিসেবে উড়ুন গাইনের কারিগরির কাজও শিখে নিতেন অনেকে। সিলেটের গ্রাম অঞ্চলে কিছু কিছু এলাকায় এখনও উড়ুন গাইনের ব্যবহার প্রচলিত আছে, অনেকেই পিঠা তৈরির চালসহ বিভিন্ন রকম মশলার গুঁড়ো করার কাজে এটি ব্যবহার করে থাকেন এখনও এবং এ জন্যই এর কিছু অর্ডার পাওয়া যায়। জীবিকার তাগিদে বর্ষাকালে আবারও এই মিস্ত্রিরা পুরোনো পেশায় ফিরে যান। কষ্ট করে হলেও কোনো রকমে প্রতিদিন একটা গাইন তৈরি করেন অনেকে। তৈরি করার পর আবার বিক্রির চেষ্টা। করতে না পারলে বর্ষাকাল বেশ কষ্টে কাটে। প্রতিটি উড়ুন গাইন ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হয়। বছরে ১০০ থেকে ১৫০ উড়ুন গাইন বিক্রি করা যায়। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী এ পণ্যের সম্প্রসারণে তাই বাড়তি মনোযোগ কাম্য।