× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আন্তর্জাতিক নারী দিবস

সমতায় এখনও দূরত্ব রয়েছে

রোকেয়া ইসলাম

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪ ০২:৩২ এএম

সমতায় এখনও দূরত্ব রয়েছে

স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর অতিক্রান্তে নারীর উন্নয়ন-অগ্রগতি কতটা হয়েছে, এ প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে। এর ব্যাখ্যায় বলা যায়, আর্থিকভাবে আত্মোন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর যা সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল তা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু নারীর আত্মোন্নয়নের যাত্রার পথ এখনও কণ্টকাকীর্ণ। সামাজিক পর্যায়ে নারীকে এখনও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ছিল। নারী-পুরুষ ভেদাভেদ থাকবে না এ প্রত্যাশায় নানা কর্মপরিকল্পনাও নেওয়া হয়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা স্তরে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার ফলে শিক্ষা, অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তো বটেই, অপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও নারীর অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।



কৃষি খাতে নারী সব সময়ই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। শিল্প খাতেও নারীর অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে ক্রমেই বাড়ছে। আমরা জানি, তৈরি পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকের ব্যাপক অবদান রয়েছে। নারীর শ্রমের মূল্যায়নের জন্যও ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। সামাজিক পর্যায়ে নারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার ফলে নারী মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে নারী কর্মী-শ্রমিকদের ওপর বিভিন্ন সময় মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যায়। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এখনও সমাজে জিইয়ে আছে। সামাজিক পর্যায়ে ভাবনাগত প্রতিবন্ধকতা নারীর উন্নয়ন-অগ্রগতি ব্যাহত করছে। প্রতি বছরের মতো এবারও পালিত হচ্ছে নারী দিবস। জাতিসংঘ এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে অর্থনীতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়টিতে জোর দিয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর বেতনবৈষম্য কমানোর জন্য এমন প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নারীর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের বিষয়টি নিশ্চিত হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন-অগ্রগতির পথ সুগম হবে, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।

কর্মক্ষেত্রে নারীকে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। নারীকে ঘরদুয়ার সামলেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী এ দুয়ের সমন্বয় করতে পারে না বিধায় তাকে যেকোনো একটি বেছে নিতে হয়। কর্মক্ষেত্রে নারীকে অন্তর্ভুক্ত করার স্বার্থে তার জন্য কোটা নির্ধারণ করা হয়। জাতীয় সংসদে নারী রাজনীতিকরা যেন অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন এজন্য সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে। ঘর ও কর্মস্থলÑদুটো সামলানোর কঠিন কাজ করতে গিয়ে অনেক নারীই প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রসঙ্গ আনতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ শিক্ষক সহকর্মী নারী শিক্ষক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক তুলনায় যোগ্য হয়ে থাকেন। এ যোগ্যতার নিরিখে আমরা দক্ষতা যাচাই করতে না পারলেও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তা বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়।

শহরে অনেক নারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অনেক দূর এগিয়ে গেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাস্তবতা এখনও ভিন্ন। তবে আশার বিষয় হলো, আমাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রসারিত হয়েছে। তার পরও সমাজে কূপমণ্ডূকতা জিইয়ে আছে। ফলে নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়। শহরাঞ্চলে অভিভাবক এখন নারীকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হয়েছে বটে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পুরো দেশে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখা যায় না। তাই নারীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে নারী কোটার ব্যবস্থাটি এখনও প্রাসঙ্গিক।

আমরা বলছি, নারীকে তার মতামত প্রদানসহ সবক্ষেত্রে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা দেওয়া হোক। নারীর অধিকার আদায়ে অনেকে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। অথচ নারী নিজগৃহেই বৈষম্যের শিকার। বিশেষত এখনও নারীকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে হেয় করা হচ্ছে। নারীর বুদ্ধিমত্তা হেয় করে এখনও একটি বহুলপ্রচলিত প্রবাদ ব্যবহৃত হয়, ‘তোমার চৌদ্দো হাত কাপড়ে দেড় হয় না, তোমার কি বুদ্ধি!’ বাস্তবে দেখা যায়, ওই পুরুষ নারী থেকে নানা দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ সম্ভব নয়। তবে সমাজে নারীর অবস্থান কেমন তা প্রবাদ-প্রবচন কিংবা নারীর প্রতি পুরুষের আচরণে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। শুধু নারী হওয়ায় পুরুষ এখনও নানাভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে থাকে। আরেকটি প্রবাদে বলা হয়, ‘মেয়েলোক কাঁচির ধার কি বোঝে?’ নারীর কারিগরি দক্ষতা হেয় করে এমন প্রবাদের ব্যবহার। নারী এখন কাঁচির ধার ভালো বোঝে। তৈরি পোশাক শিল্পে নারীর উপস্থিতি ও কারিগরি দক্ষতা ঈর্ষণীয়। তারা আধুনিক ও জটিল মেশিনে কাপড় তৈরি করে।

শুধু শ্রম খাতেই নারীর পদচারণা সীমাবদ্ধ নয়, এও এখন অনেক স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। নারী এখন অনেক সংস্থার চেয়ারম্যান হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে নারীকে কোটার ওপর নির্ভর করতে হয় না। অনেক নারী পুরুষের সঙ্গে সমানতালে প্রতিযোগিতা করে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাচ্ছে। প্রাইভেট সেক্টরেও নারীর কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে। নারীর সাফল্যের নজির কম নয়। তার পরও সমাজের অনেকেই নারীর নিরাপত্তার অজুহাত তুলে তাকে ঘরে আবদ্ধ রাখতে চায়। নারীর পদচারণ বাধাগ্রস্ত হয় এভাবেই। নারী তখন প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। অনেক পরিবারে নারীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয় তার সার্টিফিকেটের যোগ্যতা যুক্ত করতে। নারী শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করে স্বাবলম্বী হবে এমন ভাবনা অধিকাংশ পরিবারে নেই। বরং পরিবার ভাবে কীভাবে মেয়েটিকে ভালো পরিবারে বিয়ে দেওয়া যায়। নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা শুধু বিয়ের সুযোগের বিষয় হওয়া উচিত নয়। সমাজে এ ভাবনার পরিবর্তন আনা জরুরি।

নারী সাক্ষরতার হার বেড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর অংশগ্রহণ ও সাফল্যও কম নয়। কিন্তু অনেক পরিবারে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে থাকলে বৈষম্য করা হয়। নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতাকে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির বিষয় হিসেবে ভাবা হয় না বিধায় এমন ভাবনা কাজ করে। অভিভাবকরা ভাবেন, মেয়েকে বিয়ে দিলে সে অন্য পরিবারের সদস্য হবে। তাই ছেলের শিক্ষায় তারা বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি এর ফল হয় উল্টো। নারী যখন আত্মসচেতন হয়ে ওঠে, তখন নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিজেকে দক্ষ করে তোলার বিষয়ে যত্নশীল হয়। প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার নিরিখে পিছিয়ে পড়া নারীও নানাভাবে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার মাধ্যমে নিজে স্থিতিশীল হয়। পাশাপাশি নিজের পরিবারের ছায়া হয়ে ওঠে। তৈরি পোশাক শিল্প খাতের দিকে তাকালে বিষয়টি বোঝা যাবে।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান এ খাতটির সিংহভাগ শ্রম আসে নারী থেকে। নারীর শ্রম-ঘাত-মেধা-কারিগরি দক্ষতায় শিল্প খাতটি সম্প্রসারিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে নানা ক্ষেত্রে নারীর সাফল্য দেখা যাচ্ছে। আজ থেকে শত বছর আগে বেগম রোকেয়া নারীকে যে অবস্থানে দেখতে চেয়েছিলেন তা যেন বাস্তব হওয়ার পথে। নারীর শত সাফল্য সত্ত্বেও কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। নারীর নিরাপত্তা সংকটের মুখে এর বহুমাত্রিক চিত্র দৃশ্যমান। ঘরে-বাইরে কোথাও নারীর নিরাপত্তা নেই। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে নারীকে নানাভাবে প্রতারিত করতে তৎপর অশুভ মহল। তৈরি পোশাক শিল্পে নারী শ্রমিকদের কাজের স্বার্থেই রাতে যাতায়াত করতে হয়। বাড়ি কাছে থাকার পরও নারী যাতায়াতের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকে। গণপরিবহনেও নারীর নিরাপত্তা নেই, এ অভিযোগ বহু পুরোনো।

গণপরিবহনে অব্যবস্থাপনার নেতিবাচকতার শিকার নারী-পুরুষ উভয়েই। কিন্তু গণপরিবহনে যাতায়াতের ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান ও পুরুষের অবস্থান আলাদা। একজন নারী অফিসে যাওয়ার পথে সহজে গাড়িতে চড়তে পারে না। অফিসমুখী মানুষ গাদাগাদি করে বাসে যাতায়াত করে। অনেক ক্ষেত্রে গাড়িতে ওঠার জায়গা নেই বলে নারীকে গাড়িতে চড়তেও দেওয়া হয় না। নারী কোনোভাবে গাড়িতে উঠে পড়লে গণপরিবহনেও তাকে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়, এমন নজিরও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে। নারীকে অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তিকরণের ক্ষেত্রে তার যাপিত জীবনের পথ মসৃণে সবার ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। জনসংখ্যার অর্ধেক অর্থাৎ নারীর শ্রম ও মেধার অবমূল্যায়ন করে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। নারীর সুযোগসুবিধা নানাভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে বটে, কিন্তু নারীর আত্মোন্নয়নের পথে এখনও নানা প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। সমতার দাবি নতুন নয়, কিন্তু এর দূরত্ব এখনও ঘোচেনি। বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করার লক্ষ্যে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। জরুরি সাংস্কৃতিক জাগরণও। সাম্যের আলো ছড়াক চারদিকে।


  • কবি ও চেয়ারম্যান, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা