× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আন্তর্জাতিক নারী দিবস

নব জাগরণের ঢেউ

মো. অহিদুর রহমান

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৪ ০২:২৮ এএম

নব জাগরণের ঢেউ

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে লেখক মদনমোহন তর্কালঙ্কার লিখেছিলেন, বিশ্বিপিতা স্ত্রী ও পুরুষের কেবল আকারগত কিঞ্চিত ভেদস্থাপন করিয়াছেন মাত্র, মানসিক শক্তি বিষয়ে কিছুই ন্যূনাধিক্য স্থাপন করেন নাই। অতএব বালকেরা যেরূপ শিখিতে পারে বালিকা সেইরূপ কেন না পারিবেক।’ বাউল কবি লালন শাহ বলেন, ‘বামন চিনি, পৈত্য বামনি চিনি, প্রমাণ কিসেরে?’ জেন্ডার শব্দটি না জেনেও তারা নারী-পুরুষের সামাজিক ভেদজ্ঞান বুঝেছিলেন নিজেদের সহজ পদ্ধতিতে। আরজ আলী মাতুব্বর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নারীমুক্তির কথা বলেছিলেন। তারা তো নিজের মতো করে এ সমতার চিন্তা করেছিলেন। লেখনীতে এনেছিলেন। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ও কামরুল হাসান নারীকে এঁকেছেন সমতার প্রতীক হিসেবে। নারীকে পুরুষের সমমর্যাদায় তুলে ধরেছেন তাদের তুলির আঁচড়ে। ১৮৭৩ সালে কলকাতা বেঙ্গল থিয়েটারে মাইকেল মধুসূদন দত্তের যেসব নাটক মঞ্চস্থ হতো তিনি নাটকের মালিকদের বলেছিলেন, আমার নাটকে নারী চরিত্রে নারীদেরই অভিনয় করতে দিতে হবে, না হলে আমার নাটক মঞ্চস্থ হতে দেব না। নাটকের মালিকরা পড়ে গেলেন বিপদে। শেষ পর্যন্ত তারা নারীকেই নাটকে অভিনয় করতে দিয়েছিলেন। শুরু হলো কলকাতাসহ ঢাকার নাটকে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অভিনয়, শুরু হলো সমতার পালা। একটু একটু করে এগোতে থাকল নারীর অগ্রযাত্রা।

কৃষিসভ্যতার সূচনায় অসাধারণ জ্যোতির্বিদ খনা কৃষি, আবহাওয়া, মাটি, কৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান দান করে কৃষিব্যবস্থা উন্নত করেছিলেন। কিন্তু সমাজ ও পরিবার তা মেনে নিতে পারেনি। তার শ্বশুরের আদেশে স্বামী মিহির প্রকৃতিবিজ্ঞানী খনার জিব নিষ্ঠুরভাবে কেটে দিয়েছিল। থেমে যায় খনার বচন। কিন্তু আজ আমাদের কাছে, প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের কাছে খনা এক মহাবিস্ময়। তার বচন আমাদের সাহিত্যে মূল্যবান সম্পদ। ইছামতী নদীতে পূজা হয়। মেয়েরা পূজা দিতে যায়। ইছামতী ও কর্ণফুলী নদীর সঙ্গমস্থলে এ পূজা শুধু নারীরাই দেয়; কিন্তু পুরুষরা কেন দেয় না? জানা যায়, বন্ধ্যা নারীরা সন্তানলাভের আশায় এ পূজা দেন। কিন্তু পুরুষ কি নপুংসক হতে পারে না? তাদের কি পূজার দরকার নেই? আমাদের সমাজ সেভাবে তৈরি নয়। আমাদের চিন্তা পুরুষতান্ত্রিক, মনমানসিকতা পুরুষতান্ত্রিক। উট কপালি চিড়ল দাঁতী, গোদা পায়ে মারব লাথি। নারীর অবমাননাকর এমন বহু পঙ্‌ক্তি পাওয়া যাবে বাংলা সাহিত্যে। মধ্যযুগে তা মুখে মুখে ছড়িয়েও পড়েছে। সাহিত্যের সামাজিক এ প্রভাব আমাদের মানসপটে বদ্ধমূল।

ইলা মিত্র, প্রীতিলতা নারী নেতৃত্ব ও নারী-পুরুষের সমতায় কাজ করে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়ে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিয়েছিলেন। ফরাসি নারীবাদী কথাসাহিত্যিক সিমন দ্য বোভোয়ার ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘নারী হয়ে জন্মায় না, বরং হয়ে ওঠে।’ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১১৬৭-৬৮ সালে। মেয়েদের জন্য পড়ার সুযোগ দিলেও মেয়েরা ডিগ্রিলাভের পর নামের শেষে কোনো ডিগ্রি লিখতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি ব্যবহারে কোনো অনুমতি প্রদান করেনি। কিন্তু দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯২৪ সালে দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৮ সালে এ দাবি মেনে দিতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ধরনের নারীবিদ্বেষী নিয়ম করেছিল! নারীর প্রতি বৈষম্যের বীজটি কত গভীরে প্রোথিত ছিল!

গ্রামীণ প্রবাদে আছে, ‘হতাই মার বাণী, তলে দিয়ে গাছ কাটে আগায় ঢালে পানি’। সৎ-মাকে এভাবেই ছোট করে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু সৎ-বাবাকে নিয়ে কেন এ কথা-ও কথা লিখতে দেখা যায় না? ১ টাকার নোটে গ্রামীণ নারীর গৃহশ্রম, ধান ভানার দৃশ্য ফতোয়াবাজির কারণে বাতিল করা হয়। চাঙমা সমাজে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে চলে, থাকে, গোসল করে, খেলা করে কিন্তু তাদের মাঝে কোনো নির্যাতন নেই। যেখানে বিভেদের সমাজ প্রচলিত সেখানে নারী নির্যাতিত হবে। আমাদের স্কুলজীবনে ঐকিক নিয়মের অঙ্কে নারীকে বৈষম্যের সঙ্গে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, চারজন পুরুষের সমান কাজ করে আটজন নারী। আমাদের গণিতবিদদের চিন্তায়-লেখায় এগুলো কোথা থেকে এলো? তিন নারী যেখানে, কাজির দরবার সেখানে। তিন পুরুষ যেখানে, কাজির দরবার সেখানে কেন হবে না? চোরের মার বড় গলা। চোরের বাপের কি বড় গলা নেই? গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদ করে না। আমরা লেখনীতে পাই ছেলেবেলা। মেয়েবেলা নয় কেন? মেয়েবেলা লিখলে কি মেয়েকে বড় করা হয়ে যাবে? যে নারীর সন্তান নেই, বন্ধ্যা। যে নারীর একটি সন্তান, কাকবন্ধ্যা। পুরুষের বেলায় কেন বন্ধ্যা, কাকবন্ধ্যা নেই?

‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ যুগ যুগ ধরে কাদম্বিনীরাই প্রমাণের দায় বহন করে চলেছে। নিজের যোগ্যতা, সক্ষমতা, সততা, সতীত্ব এসব প্রমাণের দায়টা সবই যেন নারীর! নারী সমাজ ও পুরুষের কাছে যেন দায়বদ্ধ। প্রকৃতি নারীকে সৃষ্টিশক্তির আধার হিসেবে গড়ে তুলেছে। মানবসভ্যতার শুরুতে জীবনধারণের জন্য যখন পুরুষ শিকারে বের হতো, তখন সারা দিনের অবসরে নারীই প্রকৃতিতে আস্তে আস্তে কৃষিকাজ শুরু করে। সময় বদলেছে কিন্তু নারীর ভাগ্য বদলায়নি। তাই আজও সব সমাজেই পুরুষ ‘বিয়ে করে’ আর নারীর ‘বিয়ে হয়’। এ এক অদ্ভুত বৈষম্য। নারীও যুগ যুগ ধরে সব বৈষম্য মেনে চলছে। মেনেছে সতীদাহ প্রথা, বিধবা আইনসহ সব ভয়ংকর প্রথা। আজ নারীজাগরণ দেখতে পাচ্ছি দেশে দেশে। আরব দেশগুলোতেও জাগরণের ঢেউ লেগেছে।

নারী নির্যাতনের মাত্রা এমন যে, এখন আর স্ত্রীকে হত্যা করতে হয় না, স্ত্রীরাই নিজেদের নিজেরা হত্যা করে চলে যায়। স্বামীকে বাঁচিয়ে দেয়। তাদের জেলে যেতে হয় না। লোভ বাড়লে অত্যাচার বাড়ে, অনেক পুরুষই নারীদের সমকক্ষ ভাবতে পারছে না, পাারলেও কম ভাবছে। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে নারী-পুরুষে এমন বৈষম্য, নির্যাতন নেই। সমাজে নারীর অবস্থান যত নিচে নামানো যায়, যৌতুকের টাকা তত বাড়ে। এই নিচে নামানো-ওঠানোর দড়িটা পুরুষের হাতে। নারীর অগ্রযাত্রার সংগ্রামী অভিযান নারীর একার নয়। পুরুষকে এ সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীর অগ্রযাত্রার সুফল তো নারীর একার নয়, সব মানুষের। নারী জাগরণের ঢেউ যাতে প্রতিবন্ধকতার মুখে না পড়ে এই দায়িত্বও সচেতন সবার। একটি সুন্দর সমাজ ও পৃথিবীর জন্য।



  • পরিবেশকর্মী ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারী, বারসিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা