× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

ঐতিহাসিক মহালগ্নের কথা

হারুন হাবীব

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৪ ০৯:১৩ এএম

হারুন হাবীব

হারুন হাবীব

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স অর্ধশতাব্দী পেরিয়েছে। ২০২১ সালে আমরা উদযাপন করেছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এরপর পেরিয়েছে আরও দুটি বছর। স্বাধীনতার বয়স যখন ৫২ পেরিয়েছে, তখন পেছনের দিকে তাকানোর সুযোগ ঘটে, নিঃশব্দে আনমনে অথবা অজস্র শব্দে সচকিত হয়ে। প্রিয় মাতৃভূমির পথযাত্রা নিয়ে ভাবি, আমাদের প্রজন্মের ফেলে আসা রাত-দিনের কথা নিয়ে ভাবি। ভাবিÑ পেছনের সময়গুলো যে কেবলই সত্য ও সুন্দরের ছিল, সাফল্যের ছিল, তা তো নয়; অনেক কুৎসিত, অসত্য ও অসুন্দরের সময় পেরিয়েছি আমরা, যা এই স্বদেশভূমিকে যন্ত্রণার ইতিহাসে ভরিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরপর থেকেই শুরু ইতিহাসের দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়ের। এ সময় বিশেষত সামরিক ও আধাসামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের জাঁতাকলে নতুন প্রজন্মের বড় অংশ বিকৃত ইতিহাস পাঠ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ইতিহাস নিজেই তার আপন শক্তিতে নিজের সত্য খুঁজে নিতে সক্ষম। আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের মানুষ, তাঁদের জন্য সেই জাগরণ অতীব আনন্দের।


সেনাশাসিত পাকিস্তানের পিঞ্জর ভেঙে বাঙালির জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসে এমন কিছু ভিত্তিসূচক তারিখ ও মাস আছে, যা আলোকোজ্জ্বল। মার্চ এমনই এক মাস, যা ইতিহাসের উজ্জ্বল রশ্মি বিকিরণ করে। ঐতিহ্যগতভাবে এ মাসের শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দৈনিকগুলোতে লেখাপত্র হয়। এ শুধু প্রথা নয়, প্রয়োজন। কারণ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের চর্চা জরুরি। আমরা যখন অগ্নিঝরা মার্চ ও স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলি, তখন স্বাভাবিকভাবেই ভেসে ওঠে ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক মহালগ্নের কথা, যা ইতিহাসের আশীর্বাদ হয়ে আমাদের দৈন্য ঘুচিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ৭ মার্চ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক একটি দিনই শুধু নয় বরং বলা ভালো, বাঁক পরিবর্তনের স্বর্ণজ্জ্বল অধ্যায়।

৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রমনা রেসকোর্সের ভাষণটি অনন্য আসনে আসীন হয়ে আছে। এ ভাষণ বাঙালি জীবনের এক অমর মহাকাব্য, যা বাংলাদেশের জন্মের পূর্বাপর ইতিহাস তুলে ধরেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি এতটাই গুরুত্ব বহন করে যে, তা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। সেই ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্য দলিলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম আরেক দফা বিশ্বস্বীকৃত হওয়ার গৌরব লাভ করেছে। এই স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক ও সামরিক সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল, কেবল তারই স্বীকৃতি নয়; এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের গণমানুষ যে ন্যায় সংগ্রাম পরিচালিত করেছিলেন পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে, তারও স্বীকৃতি। অন্যদিকে এই স্বীকৃতি সেই বাঙালি মহাপুরুষের, যিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর মাটি ও মানুষের জন্য।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণটি অবিভক্ত পাকিস্তানের ২৩ বছরে নির্মোহ ইতিহাস, বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাস। এর তাৎপর্য নিয়ে বহুমাত্রিক মূল্যায়ন হতে পারে। প্রথমত, ভাষণটি খুবই সংক্ষিপ্ত, স্বতঃস্ফূর্ত ও তাৎক্ষণিক, মাত্র ১৯ মিনিটের মতো এবং ১ হাজার ১০৭ শব্দের। প্রায় সব অর্থেই এই ভাষণ একটি ক্লাসিক সাহিত্যের মর্যাদাসম্পন্ন, যাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে বাঙালির জীবনের মহাকাব্য বলা যায়। এর শব্দচয়ন, আবেগ, ইতিহাসনির্ভরতা, অন্তর ও বাইরের সংযত ও পরিপাটি ভাষা এবং ছান্দিক গ্রন্থনা, একদিকে যেমন পাকিস্তানের ২৩ বছরের বাঙালি নিপীড়নের নির্মোহ ধারাবিবরণী; অন্যদিকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মানবিক সভ্যতার প্রতি এর রচয়িতার অবিচল আস্থা ও দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ। সে কারণে সঠিক মূল্যায়নের স্বার্থে ভাষণটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন জরুরি। একদিকে মিলিটারি শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সেনাবাহিনী নির্বাচনী ফলাফল মানতে অস্বীকার করছে, অস্ত্রের ভাষায় হুমকি দিচ্ছে, যত্রতত্র বাঙালিদের হত্যা শুরু করেছে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগতি করা হয়েছে, ফলে গণজাগরণ তুঙ্গে উঠেছে। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব এরই মধ্যে নতুন দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে, সেই পতাকা উড়ছে সারা দেশে। শুধু তাই নয়, মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে নেতার মুখ থেকে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে।

অন্যদিকে ঢাকা সেনানিবাস এলাকায় যুদ্ধবিমান ও কামান বসিয়ে অপেক্ষা করছে সরকারি বাহিনী, স্বাধীনতা ঘোষিত হলেই জনসভায় আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। একদিকে স্বাধীনতাকামী উত্তাল জনতা; অন্যদিকে আসন্ন গণহত্যার শঙ্কা। এ পরিস্থিতিতে কী করবেন বঙ্গবন্ধু? অনুধাবনযোগ্য, জাতির পিতাকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বক্তব্য দিতে হয়েছে, যা এক দুরূহ কাজ।

দ্বিতীয়ত, চরম উত্তেজক পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু সেদিন ধৈর্য ও নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতি অবিচল আস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, বিদ্যমান সংকটময় পরিস্থিতিতে বিস্ময়কর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন। কারণ তিনি ছিলেন লক্ষ্যে অবিচল। অতএব তিনি পাকিস্তানি অন্যায়Ñঅবিচারের বিরুদ্ধে গণমানুষকে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দেন, যে ডাক ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ভাষণটি স্বাধীনতার কার্যকর ঘোষণা হওয়া সত্ত্বেও সেদিন তিনি সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। এর পরও ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল অত্যাসন্ন মুক্তিযুদ্ধের চালিকাশক্তি, সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাঁর শেষ নির্দেশনা এবং একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বিক্রম ও ত্যাগের মূল উৎস। আমরা যারা ঐতিহাসিক রেসকোর্সে উপস্থিত থেকে সেদিনের ভাষণটি শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম, তারা জানি, কীভাবে একটিমাত্র ভাষণ গোটা জাতিকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিবাহিনীতে পরিণত করেছিলÑ যা পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে দিয়েছিল।

তৃতীয়ত, এ ভাষণে পাকিস্তানের সরকারকে অকার্যকর করতে বঙ্গবন্ধু এমন এক সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, যা শান্তিবাদী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চার বহিঃপ্রকাশ। একদিকে সম্ভাব্য যুদ্ধের পথে তিনি জাতিকে প্রস্তুত করেছেন; অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক পথ থেকে বিচ্যুত হলেন না।

চতুর্থত, আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি কেবল সময়ের চাহিদা পূরণ করেছে, তা নয়; একই সঙ্গে ভবিষ্যতের চাহিদাও পূরণ করেছে। আজও যখন বাঙালিকে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, আজও যখন জাতিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতিকে পথনির্দেশ করে, নতুন শক্তিতে বলীয়ান করে।

আমি ইতিহাসবিদ নই, স্বাধীনতার জাতীয় ইতিহাসের একটি পর্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারী মাত্র। এ কারণে চোখে দেখা সময়ের স্মৃতিচারণা করি এবং সেই সময়ের পূর্বাপর পরিপ্রেক্ষিত জানার চেষ্টা করি। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বলা সঙ্গত বিবেচনা করি, তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনীসহ তার ৭ মার্চের ভাষণ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ’ বিষয়টি যেমন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি, তেমনি দাবি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের নেপথ্য মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে জাতীয় কমিশন গঠনেরও।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পাঁচ দশক অতিক্রম করেছে। আমরা যাঁরা সেই ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী, একই সঙ্গে একাত্তরের সৈনিক, তাঁরা সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ হয়েছি। কিন্তু অগ্নিঝরা মার্চ তার গৌরব নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। একের পর এক নতুন প্রজন্ম এসেছে। তারা তাদের জাতির স্বাধীনতা সংরক্ষণে ইতিহাসের দিকে তাকাক, শ্রদ্ধাভরে অগ্নিঝরা মার্চের দিকে তাকাক, তাকাক সেই মার্চের দিকে, যে মার্চ গোটা জাতিকে একত্র করে স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল।

বিশ্বাস করি, বাঙালির নতুন প্রজন্ম আজ যতটা জেগে উঠেছে, তার চেয়েও বেশি জেগে উঠবে আগামী দিনে। তারা স্বাধীনতা ও প্রগতিবিরোধী মহলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। নবতারুণ্যের এই জাগরণ আমাদের আশান্বিত করে। একসময় এক আরোপিত মনোজাগতিক আধিপত্যের কাছে জাতি আত্মসমর্পণ করেছিল। হয়তো করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু মাঘের কনকনে শীত শেষে গা ঝাড়া দিয়ে, মাথা তুলে নবতারুণ্য জাতিকে নববসন্তে রাঙিয়ে দিয়েছে। পিঞ্জর থেকে বেরিয়ে আসার দুয়ার খুলে দিয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে নবতারুণ্য তাদের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা বাংলাদেশে। এ তো ইতিহাসেরই ফিরে আসা। নবপ্রজন্মের হাতে বিকশিত হোক সত্য ও সুন্দর। যে বাংলাদেশ প্রবীণরা পাকিস্তানের পিঞ্জর থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন, সেই বাংলাদেশ আমাদের নবীনদের হাতে নিরাপদ হোক। এরচেয়ে বড় প্রশান্তি আর কী হতে পারে?

  • বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা