শিশুর বিকাশ
নাছিমা বেগম
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪ ১২:৫৭ পিএম
নাছিমা বেগম
নারী জাগরণের
অগ্রদূত মহীয়সী বেগম রোকেয়া জীবন চলার পথে সব দিকেই সার্থকতার সঙ্গে বিচরণ করেছেন।
যেসব অসঙ্গতি তার নজরে পড়েছে সমাধানে উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রাসঙ্গিক কোনো অনুষ্ঠানে
বক্তব্য প্রদানের পাশাপাশি উপযুক্ত পরামর্শসহ তার ধ্যানধারণা প্রবন্ধ আকারে তুলে ধরেছেন।১৯২০
সালের ৬ এপ্রিল কলকাতা টাউন হলে স্বাস্থ্য ও শিশু প্রদর্শনীতে বেগম রোকেয়া শিশু-পরিপালন
সম্পর্কে সারগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন। তার বক্তব্যের বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাতৃগর্ভ
থেকে শিশুর জন্ম এবং আঁতুড়ঘরে শিশুর মৃত্যুর কারণÑএমন কোনো দিক নেই যা তার দৃষ্টিগোচর
হয়নি। ‘শিশু-পালন’ শিরোনামে মূল বক্তব্য সভায় উপস্থাপনকালে তিনি উপস্থিত ভদ্রমহিলাদের
উদ্দেশে শিশুর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ এর প্রতিকারের উপায় নিয়ে
দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য তুলে ধরেন। শিশুমৃত্যুর হার সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেন, সে
সময় বাংলাদেশে ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১১১ জন লোক মারা যায়। এর মধ্যে ১০ বছরের কম বয়সি
ছেলেমেয়ে ৬ লাখ ২৪ হাজার ৭৫৫। অর্থাৎ মোট মৃত্যুর ৩ ভাগের ১ ভাগ শিশু।
১৯১৯ সালে কলকাতায়
দৈনিক ১৬টি শিশু আঁতুড়ঘরে মারা গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি যত্ন করা যেত তবে রোজ
১৪ জন করে শিশুকে বাঁচানো যেতে পারত। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ১৮৯৫ সালে শতকরা ৪৮ জন,
১৯০০ সালে জলবায়ুর কিছু উন্নতি হলে শতকরা ৪৪ এবং ১৯১৯ সালে শতকরা ৩০-৪০ জন শিশুর মৃত্যু
হয়। কেবল শিশুরক্ষার চেষ্টা করলে কোনো ফল হবে না। শিশুর মায়ের স্বাস্থ্যেরও যত্ন
করা দরকার। ‘মায়ের কর্তব্য কী, তা না জেনে শুনে কেউ যেন মা না হয়। যে নিজেই ১২-১৩
বছরের বালিকা, সে আর কর্তব্য শিখতে সময় পেল কখন? প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ভারতচন্দ্রের মতে
কুড়ি বছর বয়সের আগে মেয়ের বিয়ে দিতে নেই।’ ভারতচন্দ্রের উল্লিখিত উদ্ধৃতি দিয়ে
রোকেয়া বলেছেন, সন্তানধারণ থেকে প্রসব-পরবর্তী মায়ের প্রধান করণীয় কর্তব্য কী তা
সঠিকভাবে শিখে নিতে হবে। এ পরামর্শের সঙ্গে সঙ্গে তিনি শ্লেষোক্তি করে বলেছেন, ‘পশুরা
তাদের কাজে ভুল করে না, আমরা মানুষ কি না তাই আমাদের পদে পদে ভুল।’
উপযুক্ত পরিবেশের
অভাবে অনেক শিশু আঁতুড়ঘরেই মারা যায়। ঠান্ডা লাগবে ভয়ে গোসল ঠিকমতো করানো হয় না।
যে শিশুরা মায়ের দুধ পান না তাদের জন্য যে দুধ তৈরি করা হয় তার বাসনপত্র ঠিকমতো পরিষ্কার
করা হয় না। একবারে অনেকখানি দুধ তৈরি করে ফেলে, সেই ঠান্ডা দুধ তিন-চার বার খাওয়ানো
হয়। ‘সর্ব অঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা!’ এ রকম আরও নানা অত্যাচারের কথা উল্লেখ করে
তিনি শিশুর সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট কিছু পরামর্শ দেন । তা হলো , শিশুকে রোজ একবার নাওয়াতে
হবে। জলটা শিশুর বগলে হাত দিলে যেমন গরম লাগে কিংবা মায়ের কনুইতে যে গরম জল গা-সহা
বোধ হয় ততটুকু গরম থাকতে হবে। শীতকালে খোলা জায়গায় বা যেখানে ঝাপটা বাতাস লাগে এমন
জায়গায় নাওয়ানো যাবে না। নাওয়াবার আগে বেশ করে শর্ষের তেল মালিশ করতে হবে। স্নান
শেষ হলে তাড়াতাড়ি নরম তোয়ালে কিংবা পরিষ্কার পুরোনো কাপড়ের টুকরো দিয়ে বেশ করে
শিশুর গা মুছে দিতে হবে। শরীরের কোনো অংশ যেমন কানের পিঠ, বগল, কুঁচকি যেন ভেজা না
থাকে। নাওয়া শেষ হলে তাড়াতাড়ি শিশুকে হালকা ফ্লানেল কাপড় বা ঢিলেঢালা পরিষ্কার
শুকনো কাপড় পরাতে হবে। শিশুর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে
হবে তবে দুধ যাতে বেশি খায় সেদিকে নজর রাখা দরকার। শিশুকে কখনও ঠান্ডা দুধ বা ঠান্ডা
খাবার খাওয়াতে নেই।
নবজাতকের জন্য
প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা, দুই বছরের শিশুর জন্য ১৪ ঘণ্টা এবং চার বছরের শিশুর জন্য ১২ ঘণ্টা
ঘুমের দরকার।শিশুর শোবার ঘরে যেন পরিষ্কার বাতাস খেলতে পারে। ঘরে বাতাস আসবে, কিন্তু
শিশুর গায়ে যেন জোরে বাতাস না লাগে।শিশুদের ঠান্ডা লাগার ভয় খুব বেশি। প্রায়ই দেখা
যায় শিশু ভেজা বিছানায় শুয়ে থাকে। বিশেষত ঘুমের সময় যদি ভেজা বিছানায় থাকে কিংবা
ঠান্ডা বাতাস শিশুর গায়ে লাগে, তবে বিপদের ভয়।শিশুকে ফ্লানেলের টুকরো দিয়ে ঢেকে
রাখতে হবে।শিশুকে আলাদা বিছানায় শোয়ানো এবং মশামাছির উপদ্রব থেকে রক্ষা করার জন্য
মশারি খাটিয়ে দিতে হবে।শিশুর সামান্য অসুখ হলেও যত্ন চাই। শিশুর পরিপাক অর্থাৎ হজম
ঠিকমতো হচ্ছে কি না দেখতে হবে। শিশু কাঁদলে দেখতে হবে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না।প্রয়োজনে
ডাক্তার দেখাতে হলে ডাক্তারের উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। এ প্রসঙ্গে রোকেয়া
উল্লেখ করেন, আমি জানি অনেক সময় গিন্নিরা ডাক্তারকে ফাঁকি দেন অর্থাৎ ডাক্তারের উপদেশ
মানেন না। পরে ডাক্তারকে মিথ্যা বলেনÑহ্যাঁ ঠিক সময় ওষুধ দিয়েছে, ওই পথ্য ছাড়া আর
কিছু খায়নি। এতে শিশুর যে ক্ষতি হলো তার দায় ডাক্তারের নাকি নিজের?
মেয়েরা ১২ বছর
বয়স পর্যন্ত জড়ভরত হয়ে বসে থাকবে, তারপর তাদের বিয়ে হয়। ফল ছেলে বাঁচে না, কপাল
মন্দ। আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন আজ আমি যা বলছি তাই প্রথম বলা নয়, আমি ১৪ বছর আগে
বলেছিলাম যারা কন্যার ব্যায়াম করা অনাবশ্যক মনে করেন, তারা দৌহিত্রকে হৃষ্টপুষ্ট
‘পাহলওয়ান’ দেখিতে চাহেন কি না? রোকেয়ার মতে, শিশু মহামারির একটা বিশেষ কারণ আমাদের
দেশের বাল্যবিবাহ। আমাদের ভবিষ্যতের সুরক্ষায় জন্য দুটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ছে।
প্রথমত নারী শিক্ষার বহুলপ্রচার। দ্বিতীয়ত বাল্যবিবাহ রোধ অর্থাৎ মেয়েদের বেশি করে
লেখাপড়া শিখতে হবে, যাতে তারা নিজের শরীর যত্ন করতে শেখে। তিনি ভেবে দেখতে বলেছেন
সধবা মেয়েমানুষ বেশিরভাগ মরে কেন; কারণ তাদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয় বলে।শিশুকে রক্ষা
করতে হলে আগে শিশুর মায়েদের রক্ষা করা দরকার। তারাই হচ্ছে ভবিষ্যৎ বংশধরের জননী।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ চলমান থাকা সত্ত্বেও শিশুমৃত্যুর হার ওঠানামা করে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বেগম রোকেয়ার সুচিন্তিত পরামর্শগুলো আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী মায়েদের এ বিষয়ে সচেতন রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংস্থার কার্যক্রম বৃদ্ধির আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শিশুকে যদি জীবনের শুরুতেই যথাযথ পরিচর্যা না করা যায় তাহলে এর বিরূপ বহুমুখী হতে বাধ্য।