সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৪ ১৪:৫৬ পিএম
দেশের অর্থনীতির জোগানদার হিসেবে খাতগুলো চিহ্নিত। এর মধ্যে অন্যতম
রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। একসময় আমাদের শ্রমবাজার মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকেন্দ্রিক
থাকলেও এখন তা অনেক ছড়িয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, মালয়েশিয়া এবং আরও অনেক
দেশেই আমাদের শ্রমবাজার এখন বিস্তৃত। কিন্তু দেশের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রধান
উৎসগুলোতে শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে হুন্ডি চক্র। এই তথ্য ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর
শীর্ষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে কিন্তু বাড়েনি প্রবাসী
আয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের তরফে বৈধ পথে যেন দেশে প্রবাসী আয় আসে এজন্য ইতোমধ্যে
অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও এর সুফল মিলছে না। দেশীয় অর্থ পাচারকারীদের ছত্রছায়ায় মধ্যপ্রাচ্যের
পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও বিস্তৃত হয়েছে হুন্ডির জাল। আর এর প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত
হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। সেখানে শত শত প্রতিষ্ঠান গড়ে তার আড়ালে
হুন্ডি ব্যবসা করছে দেশীয় পাচারকারীরাÑ এ তথ্য মিলেছে ওই প্রতিবেদনে। আরও বলা হয়েছে,
আরব আমিরাত থেকে হুন্ডি চক্রের নতুন গন্তব্য ইউরোপের দেশ পর্তুগাল।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী প্রবাসী শ্রমিকদের
উল্লেখযোগ্য অংশের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বার্ষিক প্রবাসী আয়ের অর্ধেকই আসে
সেখান থেকে। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে এসব দেশ থেকে আসা প্রবাসী আয় আশঙ্কাজনক হারে কমতে
শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ এই তথ্যে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। সহজেই
অনুমেয় হুন্ডি চক্রের আগ্রাসী থাবায় দেশের অর্থনীতিতে কী ভয়াবহ অভিঘাত লাগছে। অর্থনীতিবিদদের
অভিমত, হুন্ডির পথ রুদ্ধ করতে না পারলে শুধু রেমিট্যান্স প্রবাহেই আরও ভাটা পড়বে না,
অর্থনীতির জন্যও তা ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এবং জিডিপির ক্ষেত্রেও অভিঘাত ফেলবে। সম্প্রতি
অর্থ পাচারের যে নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ, জাতীয় স্বার্থে সময়ক্ষেপণ
না করে এ ব্যাপারে পরিকল্পিত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। অসাধু রাজনীতিবিদ
ও আমলাদের অর্থ পাচারের বাহক হিসেবে হুন্ডি চক্র কাজ করছে এ অভিযোগও নতুন নয়। প্রভাবশালীদের
প্রশ্রয়ে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করে বিভিন্ন
দেশে দেশের কয়েকটি শিল্পগ্রুপ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে এটিও সংবাদমাধ্যমের পুরোনো খবর।
বিদ্যমান পরিস্থিতি সাক্ষ্য দেয়, হুন্ডি চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান
নিতে না পারলে ফর্মাল চ্যানেলে প্রবাসী আয়প্রবাহ বাড়ানো যাবে না। হুন্ডি চক্রের মাধ্যমে
দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। হুন্ডি চক্রের ব্যবসার সাফল্যের
জন্য তারা বিশ্বস্ততা প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি লেনদেনের গোপনীয়তা রক্ষায়ও সজাগ। আমরা
মনে করি, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে হুন্ডির কার্যক্রমের যেহেতু সব তথ্যই রয়েছে
সেহেতু এর প্রতিবিধান নিশ্চিতকল্পে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দুরূহ কিছু নয়। প্রবাসীরা
যাতে আরও সহজে ও ন্যায্য মুদ্রা বিনিময়মূল্যে দেশে তাদের আয় পাঠাতে পারেন এজন্য আরও
কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অভিবাসীদের একটি
বড় অংশ মূলত নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। তা ছাড়া তাদের মধ্যে রয়েছে সচেতনতার অভাবের
পাশাপাশি দেশে তাদের বৈধভাবে আয় পাঠানোর ব্যাপারে অজ্ঞতা। তা ছাড়া যে মাধ্যমে তারা
মুদ্রা বিনিময় হার বেশি পাবেন সেদিকেই ধাবিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের
আরও বেশি নজর গভীর করেতে হবে ব্যাংক বা বৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলোর মাধ্যমে কীভাবে তুলনামূলক
কম খরচ ও যথাযথ মুদ্রা বিনিময় হার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রবাসীরা তাদের আয় পাঠাতে পারেন।
হুন্ডি চক্র নানাভাবে তাদের প্রলুব্ধ করে। এর বিপরীতে সরকার এবং ব্যাংকগুলোর তরফে যথেষ্ট
কার্যক্রম নেই, এ অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ কম।
আমরা জানি, অভিবাসীদের দেশপ্রেম কম নয়। কিন্তু যাদের ‘রেমিট্যান্স
যোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং দেশের উন্নয়নে যাদের অবদান অনেক বেশি তাদের দূতাবাস
থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ে ধাপে ধাপে ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়, তা-ও অসত্য নয়। আমরা
মনে করি, অভিবাসীদের সুযোগসুবিধার ব্যাপারে মনোযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের প্রতি আরও
দায়িত্বশীল হওয়া অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়। হুন্ডি চক্রের হোম সার্ভিসের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে
সেবার মান উন্নত ও গতিশীল করারও বিকল্প নেই। একই সঙ্গে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত
ব্যাংকের শাখা-উপশাখা খোলার বিষয়টিও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। আমরা জানি,
হুন্ডি চক্রের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালীর নিবিড় যোগসাজশ রয়েছে। উভয়ে মিলে দেশের অর্থনীতির
অন্যতম জোগানদার প্রবাসী আয়ের সুফল ভোগ করে অর্থনীতির ওপর অভিঘাত ফেলে নিজেদের উদর
পূর্তি করছে। প্রবাসীরা যাতে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বৈধ পথে দেশে পাঠাতে আগ্রহী হন
এ পরিবেশ নিশ্চিত করার দায় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। আমরা আরও মনে করি, প্রবাসীদের
সামনে বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের আয় প্রেরণের গুরুত্ব উপস্থাপনের পাশাপাশি ঝুঁকির
বিষয়টিও বোঝাতে হবে। অবৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কিংবা প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে
নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি জোরালো প্রচারেও জোর দিতে হবে।
প্রবাসী আয়ে যে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে তা আরও বাড়ানোর বিষয়েও গুরুত্ব
দেওয়ার প্রয়োজন। অতীতে আমরা সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, ঈদুল আজহা কিংবা ঈদুল ফিতর উপলক্ষে
প্রবাসী আয়ের একটি বড় অংশই আসে হুন্ডিতে। নিকট অতীতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলএও)
এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্সের ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে আর
বাকি অংশের অর্ধেকেরও বেশি আসে হুন্ডির মাধ্যমে এবং নগদ আকারে। হুন্ডিতে প্রবাসী আয়
আসার কারণে একদিকে ব্যাংকে ডলার জমা হচ্ছে না অন্যদিকে নগদ টাকার চাহিদা বাড়ছে। প্রবাসী
শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করেন এবং তা বৈধ পথে পাঠালে দেশের লাভ হয়।
সরকার যদি বৈধ পথে প্রবাসী আয় আনা বাড়াতে চায় তাহলে ফর্মাল আর ইনফর্মাল চ্যানেলে মুদ্রা
বিনিময় হারের মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে তা কমানোর পাশাপাশি হুন্ডি চক্রের মূলোৎপাটনে
অবস্থান দৃঢ় করতেই হবে।