শিক্ষা
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২৪ ১৪:৫৪ পিএম
আধুনিক জ্ঞানসভ্যতার কিংবদন্তি অবেক্ষক দর্শনশাস্ত্রের জনক মহাজ্ঞানী
সক্রেটিসের মতানুসারে মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছদ বাইরের আবরণমাত্র। মানুষের সত্যিকার সৌন্দর্য
হচ্ছে হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত পরিশুদ্ধ জ্ঞান। তিনি বলেছিলেন, ‘জ্ঞানই সর্বোত্তম গুণ,
জ্ঞানই শক্তি’। শিক্ষা ও জ্ঞানের নিগূঢ় বিভাজন গর্বিত উপলব্ধিতে আনা না হলে প্রত্যয়
দুটির ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রকৃত অর্থে জ্ঞান হলো শিক্ষার পরিশীলিত-পরিমার্জিত
অনুধাবন। যে শিক্ষা অন্যের কষ্ট বা অন্য হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিজের বিবেককে তাড়িত ও বোধকে
বেদনাকাতর না করে, সে শিক্ষা কখনও জ্ঞানে রূপান্তরিত হয় না। জ্ঞানের আরেক মহান সাধক
অ্যারিস্টটল সম্পর্কে মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের জন্য হয়তো আমি আমার
জন্মদাতা পিতার কাছে ঋণী। কিন্তু আমাকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সত্যিকার মানুষ করে
গড়ে তুলেছেন আমার শিক্ষাগুরু অ্যারিস্টটল।’ বিশ্বখ্যাত বরেণ্য জ্ঞানসাধকসহ প্রায় সব
মনীষীর জীবনপ্রবাহের পথপরিক্রমায় শিক্ষাই ছিল অতীন্দ্রিয় পাথেয়। ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’
এ প্রচলিত প্রবাদবাক্য শুধু বাচনিক প্রকরণে নয়, প্রায়োগিক বিবেচনায় সর্বকালেই সভ্যতার
গুরুত্বপূর্ণ বাহন ছিল।
উন্নত বিশ্বে উন্নয়নের পেছনে প্রণিধানযোগ্য বিনিয়োগ হচ্ছে শিক্ষা।
শিক্ষার আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠক্রম, জ্ঞানসৃজনে সমৃদ্ধ গবেষণা, মেধাসম্পন্ন যোগ্যতর
শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার যথার্থ নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন ছাড়া গুণগত শিক্ষার বাস্তবায়ন
সমধিক কল্পনাপ্রসূত। শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি স্তরÑপ্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক-স্নাতক-স্নাতকোত্তরসহ
অধিকতর উচ্চশিক্ষায় প্রতিভাদীপ্ত ব্যক্তিদের প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অনুশীলননির্ভর উৎকর্ষ
ফলই নির্ধারণ করতে পারে গুণগত শিক্ষার মানদণ্ড। আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক তথ্যপ্রযুক্তি-মনন-সৃজনশীল
জ্ঞানের উন্মেষই ‘মানবপুঁজি’ বা সমৃদ্ধ মানবসম্পদ উৎপাদনে সুষ্ঠু ভূমিকা পালন করতে
পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অর্থলিপ্সু অনৈতিক কথিত
শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য মহামারি আকার ধারণ করেছে। সীমিতসংখ্যক পাঠ্যসূচিতে সীমাবদ্ধ
রেখে মুখস্থ-নকল বিদ্যার অনুকরণ-অনুসরণে শিক্ষার্থীদের মনন-সৃজনশীলতা নিদারুণ বাধাগ্রস্ত
করছে। শিক্ষার মৌলিকত্ব ধ্বংসকারী প্রাইভেট বা কোচিং বাণিজ্য জাতির মেধা-প্রজ্ঞা বিকাশে
প্রবল অন্তরায় হিসেবে প্রতিভাত। রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা-নগর-শহর ও গ্রামীণ
জনপদে রয়েছে রমরমা কোচিং বাণিজ্যের কদর্য বিস্তার।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ছোটবড় মিলিয়ে দেশে প্রায় ২ লাখ কোচিং সেন্টার
রয়েছে যা থেকে প্রতি বছর লেনদেন হচ্ছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে
না শিক্ষাবিধ্বংসী আত্মঘাতী এ প্রবণতা। জনশ্রুতিমতে, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের
অসাধু ও বেপরোয়া একশ্রেণির শিক্ষক পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া, মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন
অপকৌশল অবলম্বনে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের জিম্মি করে তাদের কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য
করছেন। কোনো প্রকার নিয়মনীতি আমলে না নিয়ে শ্রেণিকক্ষের আদলে কোচিং সেন্টারগুলোয় চলছে
পাঠদান। এমনকি কোচিং বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে বিদ্যালয় শিক্ষকদের হাতে তৈরি প্রশ্নপত্রে
পরীক্ষা নেওয়ারও নজির রয়েছে। বিশিষ্টজনদের দাবি, দেশে কোচিং বাণিজ্য নিয়ে একটা অশুভ-দুষ্ট
চক্র তৈরি হয়েছে যা দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। অতিসম্প্রতি এক স্কুলশিক্ষকের বিরুদ্ধে
তার কোচিং সেন্টারে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিভাবকসহ সব মহলে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা
নির্মিত হয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক জরিপ পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রাথমিক
থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ে।
বিশেষ করে মেট্রোপলিটন, বিভাগীয় ও জেলা শহরে প্রাইভেট পড়ে না এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা
অতিনগণ্য। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার হার বাড়ছে। এ ব্যাপারে
অভিভাবকদের উদ্বেগ খুব বেশি সক্রিয় বলে গবেষণায় উপস্থাপিত। কারণ এইচএসসিতে ভালো ফল
করতে না পারলে শিক্ষার্থীরা মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো জায়গায় প্রতিযোগিতায়
টিকতে পারছে না। অন্য গবেষণায় প্রতিফলিত, কোচিংয়ের কারণে বর্তমানে শিক্ষা ব্যয়ের সিংহভাগই
রাষ্ট্রের পরিবর্তে পরিবারের ওপর বর্তায়। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৯ ও সরকারি
সহায়তাপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্ত) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ ভাগই
পরিবার নির্বাহ করে। এ ব্যয়ের সিংহভাগই যায় কোচিং-প্রাইভেটের পেছনে। শিশু বিষয়ক আন্তর্জাতিক
সংস্থা ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী টিউশনের সঙ্গে
সম্পৃক্ত, বাকি ৮ শতাংশ টিউশনের বাইরে। ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩-এ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত
কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুই জেলার চার
উপজেলার ২৩ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী নিজ উদ্যোগে বা স্কুলে
কোচিং করে। এর মধ্যে ৫৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ নিজ উদ্যোগে, ২৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ স্কুলশিক্ষকের
কাছে এবং ১১ দশমিক ১৯ শতাংশ স্কুলে কোচিং করে। এ ছাড়া ১ দশমিক ৬২ শতাংশ স্কুল থেকে
প্রদত্ত গাইডবই ব্যবহার করে।
সচেতন মানুষ মাত্রেই জানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের কোচিং
ব্যবসা নিষিদ্ধ করে সরকার ২০১২ সালে ‘কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা’ জারি করে। ওই
নীতিমালা অনুযায়ী কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না।
তবে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিক ১০ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট
পড়াতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীদের নাম, রোল ও শ্রেণি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে
জানাতে হবে। কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে
যুক্ত হতে বা নিজে কোচিং সেন্টারের মালিক হতে পারবেন না। শিক্ষার্থীদের কোচিং পড়তে
উৎসাহিত-উদ্বুদ্ধ-বাধ্য করতেও পারবেন না। অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধান
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
এ ক্ষেত্রে মহানগরী এলাকার প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসে ৩০০, জেলা পর্যায়ের
শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২০০ এবং উপজেলা ও অন্যান্য এলাকার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১৫০ টাকা
নেওয়া যাবে। প্রতিষ্ঠানপ্রধান ইচ্ছা করলে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের এ অতিরিক্ত কোচিংয়ের
টাকা কমাতে বা মওকুফ করতে পারবেন।
নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ কোচিং বাণিজ্য
রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কোচিং বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান
পরিচালনা পর্ষদ কোনো ব্যবস্থা না নিলে সরকার ওই পর্ষদ ভেঙে দিয়ে পাঠদানের অনুমতি-স্বীকৃতি-অধিভুক্তি
বাতিল করতে পারবে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকলে
তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালায় অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
নেওয়া হবে। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এমপিও স্থগিত,
বাতিল, বেতনভাতা স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন এক ধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক-চূড়ান্ত
বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তি হতে পারে। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ননএমপিও শিক্ষক এবং
এমপিওহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া কোচিং বাণিজ্য বন্ধে তদারকি করতে মেট্রোপলিটন ও বিভাগীয় এলাকার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত
বিভাগীয় কমিশনারকে সভাপতি করে নয় সদস্যের কমিটি, জেলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক
এবং উপজেলার ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে আট সদস্যের কমিটি গঠনের
বিষয়টি নীতিমালায় বলা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতায় এ নীতিমালা দেশের কোথাও মানা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান
নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা
(মাউশি) অধিদপ্তরের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা
করে স্কুলশিক্ষকরা গড়ে তুলেছেন শত শত কোচিং সেন্টার। নীতিমালায় উল্লিখিত কমিটির কার্যকারিতাসহ
এখন পর্যন্ত একজন শিক্ষককেও কোচিং সেন্টার পরিচালনার দায়ে শাস্তির মুখে পড়তে দেখা যায়নি।
প্রাসঙ্গিকতায় মাউশির মহাপরিচালক গণমাধ্যমে বলেন, ‘কোন শিক্ষার্থী শিক্ষকের নিজের প্রতিষ্ঠানের
বা অন্য প্রতিষ্ঠানের তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। সারা দেশে এটি দেখা জনবলসাপেক্ষ ব্যাপার
যা মাউশির নেই। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধানদের এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। নতুন
শিক্ষাক্রমে এখন কোচিং করার, টিউশন পড়ার তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না। আমাদের বিশ্বাস, দিনে
দিনে কোচিংয়ের প্রবণতা কমে আসবে।’
৫ অক্টোবর, ২০২৩ বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় রাষ্ট্রপতি
শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধান অতিথির বক্তেব্যে তিনি বলেন,
‘শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসা করে যাচ্ছেন। যেটা শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার
শিক্ষা থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আপনাদের এ কোচিং ব্যবসা পরিহার করতে হবে। শুধু
জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য অভিভাবকরা তাড়াহুড়ো করে সন্তানকে একটা ভালো কোচিংয়ে দেন। তারা
মনে করেন, এ কোচিংয়ের মাধ্যমে তাদের সন্তানকে গুণগত বা ভালো শিক্ষা দিতে পারবেন। কিন্তু
ঘটছে উল্টো। এ মানসিকতা থেকে সরে আসতে হবে।’
সার্বিক পর্যালোচনায় এটি অতি সুস্পষ্ট যে, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নানামুখী বাচনিক প্রতিশ্রুতি কোনোভাবেই কোচিং বাণিজ্যের অবসান ঘটাতে পারছে না। শিক্ষা-জ্ঞান-প্রতিভা বিধ্বংসী এ কোচিং বাণিজ্যের উদ্যোক্তা-জড়িত শিক্ষকদের কঠোর আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গুণগত শিক্ষা কার্যক্রম অন্ধকারের গভীর গহ্বরে নিপতিত হবে। তা তো কাম্য হতে পারে না।