বৈশ্বিক সম্পর্কোন্নয়ন
ড. আব্দুল্লাহ হেল কাফী
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:২৭ এএম
ড. আব্দুল্লাহ হেল কাফী
দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল নির্বাচনের পর তা কেটে গেছে। তারা নির্বাচন
বিষয়ে কিছু প্রশ্ন রাখলেও বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন; এমনকি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার আগ্রহের কথা জানিয়ে
চিঠিও লিখেছেন। বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমনটিই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
সচরাচর এমন গতিধারাই বজায় রেখে পরিচালিত হয়। পশ্চিমা বিশ্ব সব সময় স্থিতিশীল কাঠামোকে
গুরুত্ব দেয়। স্থিতিশীল কাঠামোয় একটি সুসংগঠিত সরকারও পড়ে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের
প্রাক্কালে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের
প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সময় তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে
পশ্চিমা মহলের এমন আগ্রহ সঙ্গত কারণেই ভালোভাবে নেয়নি দেশের মানুষ। তবে যারা উদ্বেগ
প্রকাশ করেছিলেন তারাই এখন বাংলাদেশের সঙ্গে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করছে। আমরা জানি, দ্বাদশ
সংসদ নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে তারা
পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলেও নবগঠিত সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
পশ্চিমা দেশগুলো সচরাচর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমনটিই করে থাকে। আমরা এও জানি,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা, বাণিজ্যসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ খাতে
অংশীদারি রয়েছে। এ অংশীদারি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অস্থিতিশীল
হয়ে পড়লে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে পশ্চিমাদের বিশদ ধারণা নেই, এ অভিযোগ
বহু পুরোনো। এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তারা ভালোভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও দ্বিপক্ষীয়
সম্পর্ক স্থিতিশীল কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত
সরকার গঠিত হলে তারা আশ্বস্ত হয়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়
সরকার নির্বাচিত হলে পশ্চিমা সম্প্রদায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার সুস্থির অবলম্বন
পায়। তাই নির্বাচনের আগে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশেষত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রসঙ্গে
তাদের বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করতে দেখা যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে
অনেকটা ‘নাক গলিয়ে’ ফেলে এবং এর ফলে সচেতন মহলের সমালোচনারও মুখোমুখি হয়। তবে তারা
সব সময়ই সুস্থির সরকারকাঠামো গঠিত হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য দিচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়ও অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বিদেশিদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার
প্রসঙ্গে মন্তব্য করার সুযোগ আমরাই করে দিই। আমাদের রাজনৈতিক সংকট সংলাপের মাধ্যমে
সমাধান সম্ভব। তবে এ জন্য চাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার আস্থা। অথচ আমরা বরাবরই সংকট
নিরসনের এ পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছি যা আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। পাশাপাশি আমাদের
উন্নয়ন-অগ্রগতির পথও বিঘ্নিত হয়।
অর্থনৈতিক বিকাশ
এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে গুরুত্ব বাড়ছে বাংলাদেশের। বিশেষত কূটনৈতিক পরিপক্বতার
কারণে বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ।
বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা জরুরি। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন ও ভারত বৃহৎ শক্তি
বলেই বিবেচিত। চীন ও ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
এ তিন রাষ্ট্রের সঙ্গেই আমাদের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। এ তিন শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের
ভূরাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমীকরণ কিছুটা জটিল। তবে জটিল হলেও বাংলাদেশ এ তিন রাষ্ট্রের
সঙ্গেই কৌশলগত কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা
নয়’Ñজাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কূটনৈতিক দর্শনের এ সরল পথ বা আদর্শ
কূটনৈতিক মহল সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করছে। মাল্টিপোলার বা বহুজাগতিক বিশ্বে নিরপেক্ষ
কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো কূটনৈতিক পরিপক্বতার বিরল দৃষ্টান্তই বটে। সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিটের
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান আইসিআর এক বিশ্লেষণে জানিয়েছে, ২০২৪ সালে
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মধ্যস্থল হয়ে উঠবে। ২০২৩ সালে এ ভূখণ্ডের
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছর তা ৪ শতাংশ বাড়বে
যা অভাবনীয়। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও
প্রবৃদ্ধি বাড়ার হার শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায়ের ক্ষেত্রে
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সঙ্গত কারণেই
পশ্চিমা শক্তিগুলো এ অঞ্চলে অর্থনৈতিক স্বার্থ আদায়ের জন্য নিজেদের প্রভাব বলয়ের বিস্তার
ঘটাতে তৎপর। একই সঙ্গে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক শক্তি অর্থাৎ চীন ও ভারত নিজেদের প্রভাব ধরে
রাখার চেষ্টা করবে। স্ট্র্যাটেজিক কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের
গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশের তিন দিক জুড়ে ভারতের অবস্থান। সরাসরি ভূমি-যোগাযোগ না
থাকলেও চীন বাংলাদেশের নিকটতম দেশ। তা ছাড়া দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী দেশ বাংলাদেশ।
এ অঞ্চলে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার
রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। তাই ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রসহ
বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে নিবদ্ধ। এখানে রাজনৈতিক প্রভাব
বিস্তারের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পশ্চিমা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রভাব বলয় নির্মাণের
প্রতিযোগিতায় নিরপেক্ষ কূটনৈতিক অবস্থান ধরে রাখার মধ্যেই আমাদের জাতীয় স্বার্থ উদ্ধার
ও উন্নয়ন-অগ্রগতির সম্ভাবনা নিহিত।
আমরা জানি, কূটনীতিতে
কৌশলগত পদক্ষেপের পাল্টা কিছু ঘটাই খুব স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক চ্যানেলকে সব
সময় সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। মাল্টিপোলার বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার
এবং তথ্য সম্পর্কে সজাগ থাকার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক মহল বরাবরই দক্ষতা
দেখিয়েছে। তবে তাতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার অবকাশ নেই। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের কারণে
আমাদের অর্থনীতি কিছুটা ধীরগতির হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক কূটনীতির প্রসারে তাই মনোযোগ
বাড়ানো জরুরি। নতুন বাজার অনুসন্ধান, পাশাপাশি নতুন অর্থনৈতিক খাত সৃষ্টিও সমভাবেই
গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, কূটনীতি স্থবির নয় বরং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। যেকোনো সম্পর্ক
ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন মাত্রা পায় এবং এটিই স্বাভাবিক। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের
পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত।
বলছি আমাদের অর্থনৈতিক
কূটনীতি পরিচালনা করতে হবে। আমাদের জন্য রোহিঙ্গা সংকট কঠিন কিংবা জটিল বাস্তবতা। সম্প্রতি
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে। দেশটির জান্তা সরকার ও জাতিসত্তার
ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ
করেছে। মিয়ানমারের গৃহদাহের নানামুখী বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়েছে। সংকটের মুখে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। বিভিন্ন মহলের আশংকা, ধারাবাহিকভাবে কয়েক বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
বিষয়ে মিয়ানমারের অনীহা এখন আরও জোরালো হয়ে উঠতে পারে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ প্রসঙ্গে
বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থান রেখেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ কূটনৈতিক
মহলে বরাবরই জোর দিচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত
ভূমিকা রাখেনি। কিন্তু রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তুমুল লড়াইয়ের
পরিপ্রেক্ষিতে আবার আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে এসেছে রোহিঙ্গা সংকট। বিশেষত রাখাইনে
দুই পক্ষের সংঘাতের জেরে বাংলাদেশ সীমান্তে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে
আলোচনা বাড়ছে। কারণ মিয়ানমারের সঙ্গে চীন, থাইল্যান্ড, লাওস ও আমাদের প্রতিবেশী ভারতের
সীমান্ত রয়েছে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের রয়েছে বিশাল সীমান্ত। বাংলাদেশের তিন দিকে রয়েছে
ভারতের সীমান্ত। ফলে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের একটি সীমান্ত এ ভূখণ্ডের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে
স্পর্শকাতর অবস্থানে রয়েছে।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশ কোনো কারণে অশান্ত হলে অশান্ত হবে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া। এর প্রভাব পড়বে দুই অঞ্চলের অর্থনীতিতে যার বাইরে নয় চীন ও ভারত। সঙ্গত কারণেই চীন ও ভারত বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। মিয়ানমারে সৃষ্ট পরিস্থিতি আর তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সীমাবদ্ধ নেই। বরং তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। দেখার বিষয়, চীন ও ভারত এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখবে। যদিও আঞ্চলিক সংকট নিরসনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এ দুই দেশের জন্য বড় বিষয় নয়। কিন্তু সংকট নিরসনে বাংলাদেশের সহযোগিতা এ দুই দেশের প্রয়োজন। রাজনীতি-কূটনীতি বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা, মিয়ানমারে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তিন দেশের মধ্যে একটি আঞ্চলিক জোট গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কৌশলগত অবস্থান ধরে রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে দরকষাকষি করতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতি আমাদের জন্য বাঞ্ছনীয়। তবে জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই।