ডায়াবেটিস
ড. অরূপরতন চৌধুরী
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:২১ এএম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:২৬ পিএম
ড. অরূপরতন চৌধুরী
ডায়াবেটিস বর্তমানে মহামারি রোগ হিসেবে চিহ্নিত এবং এই রোগ সারা জীবনের
রোগ। নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের
জটিলতা অনেক। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ডায়াবেটিস বৃদ্ধির হার বেশি। ২০০৩
সালে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগী ছিল ১৯ কোটি। ২০৩০ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার আশঙ্কা
রয়েছে। উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ডায়াবেটিসকে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হিসেবে
ধরা হয়। সুতরাং প্রতিদিন যেমন ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে ডায়াবেটিক
রোগীদের নানা ধরনের জটিলতা। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে
প্রতিবছরের মতো এবারও পালিত হচ্ছে জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠা দিবসকে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস
হিসেবে পালনের উদ্যোগ নেয়। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ডায়াবেটিস প্রতিরোধের এখনই
সময়’।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশনের সম্প্রতি
তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতি ১০ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যু হয় এবং দুজন নতুন
ডায়াবেটিস রোগী শনাক্ত হয়! বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিসকে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বংশগত কারণ ছাড়াও নগরায়ণ ও পরিবর্তিত জীবনধারণের কারণেই ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দিন
দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে নগরায়ণের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে সারা বিশ্বেই
ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তবে বৃদ্ধির এই হার উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অন্যান্য
উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে বেশি। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে
আক্রান্ত নারীদের প্রায় অর্ধেক পরবর্তীকালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। এমনকি অপরিকল্পিত
গর্ভধারণের কারণে শিশু অপুষ্টির শিকার হলে এবং সেই শিশু পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর অতিরিক্ত
ওজন হলে তার ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেশি থাকে। প্রতিটি মা যদি গর্ভধারণের আগেই
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সন্তান জন্ম দিতে
পারেন, তবে সন্তান সুস্থভাবে জন্ম দিতে পারবেন এবং মায়ের ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা দিতে
বিশেষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে সারা দেশে ‘গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা কেন্দ্র’ খোলা
হয়েছে, যেখানে নির্ধারিত সময়ে বিনা মূল্যে গর্ভধারণ-পূর্ব পরামর্শ এবং স্বল্পমূল্যে
গর্ভধারণ-সংক্রান্ত সেবা পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি
প্রসবকালীন নারী ও শিশুমুত্যুর হার যেমন কমানো সম্ভব হবে, তেমনি নারীসহ আগামী প্রজন্মকেও
ডায়াবেটিসের ভয়াবহ প্রকোপ থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
ডায়াবেটিস রোগের জন্য দাঁতের মাড়ি এবং হাড়ে (যা দাঁতকে যথাস্থানে
রাখতে সাহায্য করে) ইনফেকশন হতে পারে। অন্যান্য ইনফেকশনের মতো রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ
বেড়ে গেলে দাঁতের মাড়িও আক্রান্ত হতে পারে। এই সমস্যাকে প্রতিরোধ করার জন্য বছরে অন্তত
দুবার ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হওয়া উচিত এবং ডাক্তারকে ডায়াবেটিস সম্পর্কে অবহিত করা
প্রয়োজন। দিনে দুবার দাঁত ব্রাশ ও ডেন্টাল ফ্লস দ্বারা পরিষ্কার করা এবং ডায়াবেটিস
নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রয়োজন। ডায়াবেটিস রোগীদের দাঁতের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার এটাই
প্রধান উপায়। অবস্থা খারাপ হলে ইনফেকশন দাঁতের মাড়িতে এমনকি হাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে
পারে এবং এভাবেই দাঁত দুর্বল হয়ে নড়ে গিয়ে পড়ে যেতে পারে।
সর্বপ্রথম ডায়াবেটিস রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা প্রয়োজন।
রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখাই দাঁত ও মাড়ির রোগ প্রতিরোধের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়
পদক্ষেপ। মাড়ির অতিরিক্ত প্রদাহ অনেক সময় ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে অনেক অসুবিধার
সৃষ্টি করে। প্রতি ছয় মাস অন্তর একজন ডেন্টাল সার্জনকে দিয়ে মুখ পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
প্রতিদিন দুবেলা (সকাল ও রাতে) দাঁত ব্রাশ এবং মাড়ির জন্য প্রয়োজন একটি নরম টুথব্রাশ।
ব্রাশটিকে ওপরের পাটির দাঁত থেকে নিচের পাটির দাঁতে আবার নিচের পাটি থেকে ওপরের পাটির
দিকে, এভাবেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দাঁত ও মাড়ি পরিষ্কার করা বিজ্ঞানসম্মত। দুই দাঁতের ফাঁক
থেকে খাদ্যকণা বের করে দেওয়ার জন্য ডেন্টাল ফ্লস বা এক ধরনের সুতা ব্যবহার করা ভালো।
কখনও যদি আপনার মাড়ি থেকে দাঁত ব্রাশের সময় বা খাবার খাওয়ার সময় রক্ত বের হয়, তবে তা
আপনার মাড়িতে প্রদাহের পূর্ব লক্ষণ কি না, বোঝার জন্য অবশ্যই একজন ডেন্টাল সার্জনের
পরামর্শ গ্রহণ প্রয়োজন। ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণই অন্যান্য জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার
একমাত্র চাবিকাঠি। বয়স যদি ৪০-এর বেশি হয় এবং ওজন যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় কিংবা বংশে
যদি কারও ডায়াবেটিস থাকে, তবে অবশ্যই বছরে একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা প্রয়োজন এবং
গর্ভবতীরা নিশ্চিত করা প্রয়োজন তাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে কি না। তামাক ও ধূমপানের
সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ধূমপান ও তামাক সেবন ডায়াবেটিসের
ভয়াবহতা এবং জটিলতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তরুণ বয়সে ধূমপান
শুরু করে তারা পরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন কেউ যদি ধূমপান,
তামাক সেবন করে, তবে তাদেরও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। ফলে তাদের মধ্যে ফুসফুসের
ক্যানসার, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও পায়ের পচনশীল রোগ ‘গ্যাংগ্রিন’ হওয়ার সম্ভাবনা ৫ গুণ বেশি।
তা ছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের ধূমপানের কারণে ‘মাড়ির রোগ বা পেরিওডেন্টাল ডিজিজ’-এর জটিলতা
বেশি হয় এবং অকালে দাঁত পড়ে যায়।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ডা. মো. ইব্রাহিমের অমর বাণী- ‘প্রত্যেক ডায়াবেটিক রোগী যদি পরিমিত খাদ্যগ্রহণ, নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ এবং রক্তপরীক্ষা ও নিয়মিত ব্যায়াম- এই তিনটি নীতিকে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন মেনে চলেন তাহলে তারা অবশ্যই স্বাভাবিকের কাছাকাছি, সামাজিকভাবে উপযোগী, সৃজনশীল কাজে সক্ষম ও সম্মানজনক জীবন নির্বাহ করতে পারবেন।’ প্রতিকারের চাইতে প্রতিরোধই শ্রেয়, সস্তা ও নিরাপদ।