সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৫৭ এএম
বিগত দেড় দশকে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কৃষি, শিল্পসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি-উন্নয়নের যে বাস্তবতা দৃশ্যমান এরই ফের প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্বব্যাংকের দায়িত্বশীল মহলের তরফে। ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ, বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশনস) আন্না বিজার্ড বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অনেক দেশের জন্য অনুপ্রেরণা। ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে প্রথম সফরে এসে এক বিবৃতিতে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেছেন, মুদ্রা ও রাজস্বনীতিতে দ্রুত এবং সাহসী সংস্কার বাংলাদেশকে সামষ্টিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে, আর্থিক খাতের ঝুঁকি কমাতে এবং বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম করবে। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সাফল্যের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করার পাশাপাশি সহযোগিতা ও সমর্থন দানের বিষয়টি তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন।
বিশ্বব্যাংকের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্না বিজার্ড বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অংশীদারত্বের ব্যাপারে
গর্ব প্রকাশের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ননীতিরও প্রশংসা করেন। একই
সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে স্বভূম ত্যাগকারী নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয়দান
ও প্রতিপালনেরও প্রশংসা করেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন
না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। আমরা তাকে অভিনন্দিত
করার পাশাপাশি এ-ও বলতে চাই, চলমান বৈশ্বিক সংকট ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার
মধ্যেও বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি এবং সরকারের দূরদর্শী রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি নিশ্চয়ই
সাধুবাদযোগ্য। তবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুষ্ট করার পাশাপাশি সামগ্রিক অগ্রগতির
পথে কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম আর্থিক খাতে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা, অর্থ
পাচার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ঘাটতি, বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতাসহ
আরও কিছু বিষয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর আওয়ামী লীগ সরকার যাত্রা শুরু করে
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোয় ফের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে
জনগণের স্বস্তি ও কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। আমরা দেখেছি, বিগত জাতীয়
সংসদ নির্বাচন প্রতিরোধে এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারের নামে ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক
কর্মসূচি চালিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং এখনও তারা চরম বিধ্বংসী রাজনীতির পথ পরিহার
করেনি। আমরা জানি, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অন্যতম
জরুরি অনুষঙ্গ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বায়ান্ন বছরের এই বাংলাদেশে জনকল্যাণের অন্যতম
মাধ্যম রাজনীতির পথ হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের অপপ্রয়াসে ফিরে ফিরে কণ্টকাকীর্ণ হয়েছে।
এর মারাত্মক অভিঘাত লেগেছে জনজীবনের পাশাপাশি অর্থনীতিতে।
আমাদের প্রবৃদ্ধি
অর্জনের অন্যতম শক্তি প্রবাসীরা, যাদের ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
কিন্তু আমরা দেখেছি, কখনও কখনও প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে তাদের আয় দেশে না পাঠিয়ে অবৈধ
প্রক্রিয়ায় পাঠাতে উৎসাহিত হন। এর পেছনের কারণগুলোও সচেতন মানুষমাত্রেরই অজানা নয়।
হুন্ডি কারবারিদের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান কিছু সমস্যা
এর অন্যতম একটি কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসীরা যাতে বৈধ পথে তাদের আয় দেশে প্রেরণ
করেন এজন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা সাধুবাদযোগ্য। এর মধ্যে অন্যতম, প্রবাসী আয়ে বাড়তি
প্রণোদনা দেওয়া। আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে আরও পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি প্রবাসীদের
মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের পরিসর বাড়াতে আরও উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে আর্থিক
খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নির্মোহ অবস্থান নিশ্চিত করতেই
হবে। বৈদেশিক বাণিজ্যের নতুন কর্মপরিকল্পনা সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। রপ্তানি আয় বাড়াতে
নতুন নতুন বাজার সন্ধানের পাশাপাশি আমাদের রপ্তানি তালিকাভুক্ত পণ্যগুলোর বহুমুখীকরণও
জরুরি। মনোযোগ বাড়াতে হবে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে। বিদেশি বিনিযোগ বাড়ানোয় আরও দূরদর্শী
কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার পাশাপাশি এক্ষেত্রে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো রয়েছে তা দূর করতে বিদ্যমান
বাস্তবতার নিরিখে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দেশের অর্থনীতির
আকার বেড়েছে, বৈদেশিক বাণিজ্য অনেকাংশে সম্প্রসারিত হয়েছে, রপ্তানি আয়ে নতুন দিগন্তও
উন্মোচিত হয়েছে। তবে আমরা মনে করি, এখানেই থেমে থাকার অবকাশ যেমন নেই তেমনি আত্মতুষ্টিতে
তুষ্ট থাকারও অবকাশ নেই।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে
ধারাবাহিকতা অর্জন স্ফীত করতে গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে মনোযোগ আরও গভীর করতে হবে। আয়
বৈষম্য ঘোচানোর পাশাপাশি সমাজে সাম্যের আলো ছড়াতে হবে। আমরা জানি, তৈরি পোশাক ও কৃষি
খাত আমাদের অর্থনৈতিক বাঁক পরিবর্তন-উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখছে। কৃষির আধুনিকায়নসহ
কৃষিজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় সময়ের চাহিদার প্রেক্ষাপটে যথোপযুক্ত
পদক্ষেপ নেওয়াও সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। দারিদ্র্যরেখাচিহ্ন ক্রমান্বয়ে মুছে ফেলে
গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে এমন কর্মপরিকল্পনার
সুচারু বাস্তবায়নও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। আত্মকর্মসংস্থামূলক ব্যবস্থার পথ মসৃণ করার
পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা নিশ্চিত করে এমন বিষয়ে মনোযোগ বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি বলতে নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার উৎপাদন বৃদ্ধি বোঝায়।
আমরা এ-ও জানি, একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা উন্নতি করছে তার প্রধান নিয়ামক মানদণ্ড
হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান মূল্যস্ফীতি এক্ষেত্রে যে অন্তরায় সৃষ্টি
করে আছে এর কারণগুলোও অচিহ্নিত নয়।
আমাদের স্মরণে
আছে, বিগত করোনা দুর্যোগ ও বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দার সময়েও আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
সন্তোষজনক পর্যায়ে ছিল এবং এজন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক ও দাতা সংস্থা এবং আমাদের উন্নয়ন
সহযোগীরাও নীতিমালার প্রশংসা করেছিলেন। আমরা মনে করি, আমাদের সম্ভাবনা যেহেতু ব্যাপৃত
সেহেতু খেলাপি ঋণ আদায়সহ অর্থনীতির সব ক্ষত উপশমে সরকারকে আরও নির্মোহ ও দূরদর্শী পদক্ষেপ
নেওয়া জরুরি। মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার, বৈদেশিক মুদ্রার টানাপড়েন ইত্যাদি
একটির সঙ্গে অন্যটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উদীয়মান ও ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির এ দেশে কিছু
নীতিহীন সাবির্ক কল্যাণ-অগ্রগতির প্রতিবন্ধক হয়ে থাকতে পারে না। আমরা মনে করি, অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সরকার এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষমতার
পরিচয় দেবে। সরকারের অর্জন মানে জনগণের কল্যাণ। আমাদের প্রত্যাশা, দেশ-জাতির কল্যাণে
সরকারের বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা ও নীতি দর্শনের সুফল আরও ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হবে।