পরিপার্শ্ব
মো. আব্দুল হাই বাবু
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৪৯ এএম
হায়দার আলী পেশায়
ভ্যানচালক। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শেখমাটিয়া ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের বাসিন্দা।
অভাব-অনটন আর নিয়তির সঙ্গে লড়াই শৈশব থেকেই। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে থাকা হায়দার আলী
ভ্যান চালানোর পাশাপাশি দিনমজুর কিংবা মাছ ধরেও জীবিকা নির্বাহ করেন। জীবিকা নির্বাহের
পাশাপাশি লেখালেখিও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হায়দার আলী ১৯৯৪ সালে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক
পাস করেন। সংসারের অভাব-অনটনের কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে শিক্ষাজীবনের ইতি টানতে হয় তার।
দীর্ঘ শিক্ষাবিরতির পর ২০১৩ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি)-এর একাদশ
শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরিবারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যান। এ করে ৩.৮৩
পেয়ে এইচএসসিতেও এলাকায় চমক দেখান তিনি। ২০১৮ সালে নাজিরপুর কলেজে ডিগ্রিতে উন্মুক্ত
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সম্প্রতি বাউবির বিএ/বিএসএসের প্রকাশিত ফলাফলে ২.৮৩ (জিপিএ)
পেয়ে উত্তীর্ণ হন হায়দার আলী।
জীবনে কোনো কিছুই
বাধা হতে পারেনি হায়দার আলীর শিক্ষা অর্জনের পথে। ভ্যান চালানোর পাশাপাশি লেখাপড়া অদম্য
আগ্রহের কারণে রাতে পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পড়লে এবং দিনে ভ্যান চালানোর ফাঁকে ফাঁকে
পড়ালেখা চালিয়ে যেতেন হায়দার। ইংরেজিতে তার খুব দখল। ইংরেজি অনুশীলন ও নতুন শব্দ শেখার
আগ্রহ তার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে। রেডিও বাজিয়ে মনোযোগ দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদের
খোঁজখবর রাখার সঙ্গে শেখার অনুশীলনও চালান সমানতালে। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন গড়ে তিন-চারশ
টাকা আয় হয়। পৈতৃক সম্পত্তির মধ্যে তার একটি ঝুপড়িঘর আর মাত্র ৩ শতাংশ জমি। হায়দার
আলী এখন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের স্বপ্ন দেখছেন। যত সময় লাগুক, এমএ পাস করার দৃঢ়প্রত্যয়
ব্যক্ত করেছেন। চাকরি প্রাপ্তি তার উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার মূল বাসনা নয়। হায়দার
আলীর মতো সুযোগবঞ্চিত, অবহেলিত, বয়স্ক ও অদম্য শিক্ষার্থীর শিক্ষার সুযোগ সম্পর্কে
বাউবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘হায়দার আলী একটি সাহসের নাম।
সংগ্রামী, পরিশ্রমী, দৃঢ়, অপরাজিত, স্বপ্নবান একজন। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের আদর্শ তিনি।
এ রকম মানুষের পাশে সব সময় রয়েছে বাউবি। প্রযুক্তির কল্যাণে আমাদের শিক্ষাক্রম এখন
সারা দেশেই সব বয়সের, পেশার নাগরিকের ঘরে বসে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিচ্ছে।’
আমরা জানি, বাউবি
দেশের বাইরেও স্টাডি সেন্টার খুলেছে। দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত,
ইতালিতে অবস্থানরত বাঙালি রেমিট্যান্স যোদ্ধারা সেখানে বসে এখন বাউবির বিভিন্ন প্রোগ্রামে
শিক্ষা গ্রহণ করছেন। পটুয়াখালীর সাগরপারের জেলে হাসান পারভেজ, কিশোরগঞ্জের চা বিক্রেতা
হারুন মিয়া, বগুড়ার হুইলচেয়ারের যোদ্ধা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী নুরজাহান রিয়া কিংবা
নারী সাফ ফুটবল দলের সাবেক ক্যাপ্টেন সাবিনা খাতুন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক
ওবামার ফটোগ্রাফার নিজামুল বিশ্বাসÑএরা সবাই বাউবির শিক্ষার্থী। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে
দেয়ার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা জরুরি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতার বাইরেও কিছু
মানুষ আলোর সন্ধানে সবসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান। তারা দৃষ্টান্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানকে
ছড়িয়ে দেন আরও বৃহৎ পরিসরে। হায়দার আলী তেমনই একজন। উচ্চশিক্ষার যে স্বপ্ন তাকে তাড়িত
করেছে এই স্বপ্ন যেন অধরা না থাকে।