মিয়ানমারে গৃহদাহ
মোহাম্মদ আলী শিকদার
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:২৯ পিএম
মধ্যে তিন-চার দিন বিরতি দিয়ে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দে আমাদের সীমান্তবর্তী জনপদে আবার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, মিয়ানমারের স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মি ও তাদের জোটসঙ্গীরা একের পর এক থানা দখল করছে। এ প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করছে বলে জানিয়েছে সে দেশের গণমাধ্যম ইরাবতী। মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতি নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা যায়। তবে মোট কথা, মিয়ানমারের গৃহদাহ আমাদের জন্য ক্রমেই বহুমাত্রিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইতঃপূর্বে মিয়ানমারে সংঘটিত ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এবং গণহত্যার কারণে বাংলাদেশ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে যে মানবিক দায়িত্ব পালন করছে, এর প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায় কতটা দৃশ্যমান এ নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ এখন আর শুধু তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার অবকাশ নেই। প্রতিবেশী দেশটির অভ্যন্তরীণ সংকটের বড় ভুক্তভোগী আমরা। মিয়ানমারে চলমান গৃহদাহের আঁচ এসে পড়ছে আমাদের ওপরও। বিশেষত মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তাসংকট উদ্বেগ বাড়ছেই। আমরা জানি, কক্সবাজার সীমান্তবর্তী অঞ্চলটি বাংলাদেশের লাইফলাইন। ভূরাজনৈতিক ও আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থেও এই অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সীমান্ত অঞ্চল রয়েছে। আমরা জানি, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের সন্নিকটে রাখাইন অঞ্চলে জান্তা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা লাগাতার যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যুদ্ধে তারা জয়ীও হচ্ছে। সামরিক রসদের পাশাপাশি জান্তা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা হারাচ্ছেন মনোবল। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জান্তা সরকার বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারা এখনও রাজনৈতিক সমাধানের পথ অবলম্বন না করে সামরিক সমাধানের ওপরই নির্ভর করছে।
সামরিক সমাধানের ওপর নির্ভরশীলতার দরুন মিয়ানমারে সংঘাত-সংঘর্ষ জিইয়ে আছে এবং তার প্রভাব পড়ছে দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও। মিয়ানমারের সঙ্গে যে দেশগুলোর সীমান্ত রয়েছে সেসব দেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। আগেই বলেছি, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ইতোমধ্যে মিয়ানমার থেকে জান্তা সামরিক বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য তো বটেই নতুন করে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনাও ঘটেছে। অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা যখন তার নিকটবর্তী দেশের নিরাপত্তা সংকট তৈরি করে তখন তা পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ সংকট থাকে না। মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের ফের ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। নিশ্চয় বিষয়টি দুর্ভাবনার।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটে সৃষ্ট জটিলতার কত বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশ, নতুন করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। এও আগেই বলেছি, দীর্ঘদিন ধরেই নিপীড়িত- নির্যাতিত ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক তাগিদে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকের যে সংখ্যা তার থেকে দ্বিগুণেরও বেশি রোহিঙ্গা এখন সেখানে অবস্থান করছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গারা সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করায় নিজেরাই একটা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অভিযোগ আছে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্ত, ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তি। মানব ও মাদক পাচার এবং অস্ত্র চোরাচালানের জন্য রোহিঙ্গাদের সহজে ব্যবহার করে ওই ক্ষমতাশালীরা- এমন অভিযোগ ইতোমধ্যে বহুবার উঠেছে। এ স্তম্ভেই ইতঃপূর্বে বহুবার বলেছি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রুখে দেওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করছে অশুভ মহল। তারা নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করতে চায় এবং এজন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানাভাবে সংঘাত-সহিংস প্রেক্ষাপট তৈরি করে।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জরুরি। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে মিয়ানমার বরাবরই অনাগ্রহী। বরং তারা নানাভাবে আমাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে মর্টার বা গোলাবারুদ ছুড়ে উসকানি দিতে চেয়েছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিশ্বের যেসব অঞ্চলে সামরিক শাসন রয়েছে সেসব অঞ্চলে সামরিক শাসকরা পার্শ্ববর্তী কোনো দেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে চায়। রোহিঙ্গা গণহত্যা যজ্ঞের পর বৃহৎ সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সংকটাবস্থা যেমন সৃষ্টি করেছে। তাদের প্রত্যাবাসনও জটিল আকার ধারণ করেছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে আমাদের নিরাপত্তাসংকট দ্বিমুখী। প্রথমত দেশের অভ্যন্তরেই একটি পক্ষ রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে জান্তা সরকারের গুপ্তচররাও ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে, এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশ নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহল বরাবরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে জোর তদবির চালাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘাত-সহিংসতা জিইয়ে রেখে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শ্লথ করে দেওয়ার অপপ্রক্রিয়া মিয়ানমারের একটি অংশ করতে পারে, এমন অভিযোগ অনেকের। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তাঝুঁকি তাই ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করতে শুরু করছে। আর সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতিতে সঙ্গতই উদ্বেগ আরও বেড়েছে বাংলাদেশের।
সংবাদমাধ্যমে আরও প্রকাশ, কক্সবাজার-উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠনসহ গুপ্তচর সংঘের নানা শাখা-উপশাখা রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে সেনা নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বিদ্রোহী সংগঠনের সদস্যরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে বেছে নিচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তাবেষ্টনী পর্যাপ্ত নয় এ অভিযোগও নতুন নয়। যে কেউ অবাধে এখানে চলাফেরা করছে। সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কড়া নজরদারি আরও বাড়ালে এই সংকট কিছুটা হলেও কমবে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান হবে না। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলার বিষয়ে মনোযোগ বাড়াতে হবে। ক্যাম্পে সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতি নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পই নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায়ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বাড়াতে হবে গোয়েন্দা নজরদারিও। কারণ রোহিঙ্গা শিবিরে অপরাধীরা শিকড়বাকড় ছড়িয়েছে।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা বলে কিছু নেই। দুয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হয়তো আমাদের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হবে না। কিন্তু কেউ যাতে বড় পরিসরে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে সেজন্য তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং তথ্য সংগ্রহে মনোযোগী হতে হবে। আমরা জানি, সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অধিকাংশ স্থানই দুর্গম। দুর্গম অঞ্চলে নজরদারি রাখাও কঠিন। তবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সক্ষমতা আছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সনাতনী কৌশলে করলে হবে না, এ জন্য চাই আধুনিক কৌশল। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখনও বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিও রয়েছে। সেখানে তাই পূর্ণ পরিসরে অভিযান চালিয়ে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর শিকড় উৎপাটন সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর দায় এসে পড়তে পারে। এজন্য আমাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে মনোযোগ দিতে হবে বেশি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বরাবরই নীরব ভূমিকা পালন করছে। বিশেষত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কৌশলগত বন্ধুরাষ্ট্র চীনের ভূমিকা এখনও স্পষ্ট হয়নি। তবে চীনের ভূমিকা স্পষ্ট হওয়ার প্রেক্ষাপট এখন যথেষ্ট তৈরি হয়েছে তা মনে করি। কারণ মিয়ানমারে সৃষ্ট গৃহদাহে থাইল্যান্ড, চীন, লাওস, ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের নিরাপত্তা শঙ্কার মুখে পড়েছে। এক্ষেত্রে চীন ও ভারতের সংকটও কম নয়। আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থেই চীন ও ভারতকে এখন ভূরাজনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। এই তৎপরতায় বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে এই তিনটি দেশের প্রভাব রয়েছে। ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এই তিনটি দেশের মধ্যে একটি আঞ্চলিক জোট তৈরি হলে নিরাপত্তাসংকট নিয়ে কাজ হতে পারে। যদিও জোট হওয়ার মানে এই নয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনও তার অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু জোট গঠন করা গেলে কৌশলগত সম্পর্কের ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করা সহজ হবে।
মিয়ানমারে সৃষ্ট গৃহদাহ আমাদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জনজীবন শঙ্কায় ফেলেছে। সবার প্রথমে জননিরাপত্তা। পাশাপাশি কূটনৈতিক চ্যানেলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কৌশলগতভাবে এগোতে হবে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেহেতু আমরা নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছি সেহেতু আপাতত এই দুটো পথই আমাদের জন্য খোলা রয়েছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মনোযোগ আরও গভীর করতে হবে। সীমান্তের ওপার থেকে বিদ্রোহীদের কোনো উস্কানিতে যাতে আমাদের এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গারা অন্য কোনো পথ না খোঁজে তা-ও নজরে রাখতে হবে। সীমান্ত নিরাপত্তার নতুন প্রেক্ষাপটে ভারত ও চীনের সঙ্গে আলোচনার গুরুত্ব রয়েছে।