প্রেক্ষাপট
মুহাম্মাদ তাজুল ইসলাম
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:২২ পিএম
বাংলাদেশের সংবিধানে তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা'। সংবিধানের এই বিধান যথাযথভাবে কার্যকর করতে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ 'বাংলা ভাষা প্রচলন আইন' কার্যকর করা হয়। এই আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সোয়াল- জওয়াব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হবে।' ৩(২) ধারায় আরও বলা হয়েছে, উল্লেখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।' ধারা ৩ ( বলছে, ‘যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
হাইকোর্ট বিভাগের রুলের চতুর্থ অধ্যায়ের ১নং বিধিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্টে দাখিলকৃত দরখাস্তগুলোর ভাষা হবে ইংরেজি। পঞ্চম অধ্যায়ের ৬৯নং বিধিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ এবং ডিক্রি আদালতের ভাষায় প্রস্তুত করতে হবে। একইভাবে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারায় আদালতের ভাষা নির্ধারণ করতে গিয়ে ১৩৭(৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, 'কোনো আদালতের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা ব্যতীত অন্য কিছু লিখিতভাবে সম্পাদন করার জন্য অত্র কোর্ট আদেশ যা অনুমোদন করে তা ইংরেজিতে লেখা যাবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, 'যেকোনো ফৌজদারি আদালতের বিচারিক রায় আদালতের ভাষায় অথবা অন্য কোনো ভাষায়-যা আসামি অথবা তার আইনজীবী বুঝতে সক্ষম সে ভাষায় ঘোষণা অথবা উক্ত রায়ের বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করতে হবে।' অর্থাৎ আদালতে বাংলায় রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন বাধা নেই। রায় দেওয়ার সময় ইংরেজির ধারাগুলো বাংলায় অনুবাদ করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
বাংলা ভাষাকে আদালতের ভাষা হিসেবে শতভাগ চালু না করায় রাষ্ট্রের সব নাগরিক তাদের সাংবিধানিকভাবে পাওয়া মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। শিক্ষার ক্ষেত্রে, গবেষণা, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড ইত্যাদিসহ সরকারের বিভিন্ন অসি দাপ্তরিক চিঠি আদান-প্রদান করা হয় ইংরেজি ভাষায়। তা ছাড়া বাংলা ভাষা প্রয়োগ ও সর্বস্তরে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময় আদেশ হয়ে থাকলেও আদেশদানকারী অফিস বা আদালত অনেক ক্ষেত্রে তা মানে পূর্ণাঙ্গভাবে বাংলা চল হয়নি এখনও। তবে আশার কথা, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের মধ্যে বাংলায় রায় ও আদেশ দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ও উন্নতি করতে হলে ইংরেজি ভাষা চর্চা ও উন্নতভাবে শিখতে হবে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে অফিসের ভাষা, ইংরেজি ব্যতীত শিক্ষার ভাষা, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ডের ভাষা, পত্র যোগাযোগ, গণমাধ্যমের ভাষা অবশ্যই বাংলা হতে হবে। ইংরেজির মতো করে বাংলা শব্দ উচ্চারণের প্রবণতা এখন টেলিভিশন, এফএম রেডিও থেকে শুরু করে। এর প্রভাব পড়ছে যাপিত জীবনে বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। দেশে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের আইন আছে। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন অনুসারে সব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। নিজ দেশের ভাষাকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আরও শক্তিশালী করতে ও নিজেদের দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
আইন গবেষক