ভাষার মাস
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:২৪ পিএম
মহিউদ্দিন খান মোহন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও
হবে। গবেষণায় এ ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত
করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম
রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংঘটিত হয়েছিল। বাহ্যত তা মনে হলেও এর ছিল এক সুদূরপ্রসারী
বহুমাত্রিক প্রভাব, যা তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের চেতনাবোধ জাগ্রত করে তুলেছিল।
সবচেয়ে বড় কথা, এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না, ছিল সাংকৃতিক আন্দোলন। কোনো রাজনৈতিক
দল এর নেতৃত্ব দেয়নি। শুরু করেছিল এ দেশের বুদ্ধিজীবী মহল। পরে মূল স্রোতধারার সামনে
এসে দাঁড়ায় ছাত্র ও যুব সমাজ।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটলেও এর
সূত্রপাত পাকিস্তান প্রাতিষ্ঠার আগেই। ১৯৪৭ সালের ১৮ মে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত ‘ইত্তেহাদুল
মুসলিমিন’ আয়োজিত উর্দু সম্মেলনে মুসলিম লীগ নেতারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু
হবে বলে ঘোষণা করলে বাঙালি নেতৃবৃন্দ আশঙ্কা করলেন রাষ্ট্রভাষা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিরা
চক্রান্ত করবে। ওই চক্রান্ত মোকাবিলা এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে
জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা উদ্যোগী হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠার পরপরই ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক
অধ্যাপক আবুল কাশেম ও রসায়নবিজ্ঞানের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়ার উদ্যোগে সাংস্কৃতিক
সংগঠন ‘তমদ্দুন মজলিস’ গঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
বাংলা না উর্দু?’- শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে।ওই পুস্তিকায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা
প্রবন্ধ লিখেছিলেন। একই বছর অক্টোবরে তমদ্দুন মজলিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক
হলে এক সাহিত্যসভার অয়োজন করে। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা এবং সেজন্য
প্রয়োজনীয় আন্দোলন সংগঠনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এভাবে তমদ্দুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা
আন্দোলনের অঙ্কুরোদ্গম ঘটায়; যা পরে মহিরুহে রূপ নেয়।
বস্তুত ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন ছিল না,
এটা ছিল পূর্ব বাংলার মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ভাষা মানুষের সংস্কৃতির প্রধান
বাহন। ভাষা যদি স্বকীয়তা হারায় তাহলে জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিলীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
জাতির জন্য তা বহুমুখী অভিঘাতের কারণও হতে পারে। ১৯৪৭-এ তমদ্দুন মজলিস এবং ১৯৫২-তে
ছাত্রসমাজ এ সত্যটি সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিল। একপর্যায়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ফলে বাংলা
পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। এর ফলে আমাদের সংস্কৃতি সমূলে বিনাশের
মহাচক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। এটা ছিল জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের প্রথম সোপান;
যার ধারাবাহিকতায় এসেছে আমাদের স্বাধীনতা।
আজ আমরা স্বাধীন। আমাদের ভাষাও স্বাধীন। কিন্তু গত অর্ধশতাব্দীতে আমরা
আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি কতটুকু সমৃদ্ধ করতে পেরেছি? আমাদের ভাষা আন্দোলনের স্মারক দিনটি
আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এটা অবশ্যই আমাদের গর্বের বিষয়। সেই
সঙ্গে এও লক্ষণীয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ডামাডোলে শোক ও ভাবগাম্ভীর্যের ‘মহান
শহীদ দিবস’ যেন ঢাকা পড়তে বসেছে। আমরা এখন আন্তর্জাতিকমুখী। নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য,
সংস্কৃতি সম্পর্কে হয়ে পড়েছি উদাসীন। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের ভাষার কথা মনে
পড়ে। বাংলা একাডেমি আয়োজন করে বিশাল পরিসরের বইমেলা। এ মেলায় তরুণ-তরুণীরা বাংলা অক্ষরের
ছাপসংবলিত জামা-শাড়ি পরে মেলার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। যারা নিজেদের পাঞ্জাবি বা শাড়িতে
বাংলা অক্ষর ধারণ করছে, তারা কি বাংলা ভাষা সেভাবে অন্তরে ধারণ করে? অনেকে এ কথার প্রতিবাদ
করে বলবেন, আমি অন্যের দেশপ্রেমকে কটাক্ষ করছি। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, ওইসব
তরুণ-তরুণীর নব্বই শতাংশ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানে না। একটি ভিডিও ক্লিপ এখন সমাজমাধ্যমে
ভাইরাল। একজন তরুণীকে বলতে শোনা যায়, ‘২১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা দিবস’, আরেকজন বলে,
‘বইমেলা শুরু হয়েছে ২০০৬ সাল থেকে’। তাদের কেউই ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে
একটি অক্ষরও বলতে পারেনি। বলা নিষ্প্রয়োজন, মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বইমেলায়
সেজেগুঁজে এলেও এরা কেউ মেলার উপলক্ষ ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানে না। দেশ ও জাতির ইতিহাস
সম্পর্কে মূর্খ এ প্রজন্ম জাতিকে কী দেবে ভাবলে শঙ্কিত হতে হয়।
আজ আধুনিকতার নামে চলছে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বিসর্জনের অশুভ
প্রবণতা। আজকালকার ছেলেমেয়েদের অনেকেই বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুলকে
চেনে না। বইয়ের ধারেপাশে তারা যায় না। অত সময় কোথায়? তারা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে
ছুটছে। দৃষ্টি তাদের ঊর্ধ্বমুখী। শেকড়ের দিকে তাকানোর সময় নেই। অনেক মা-বাবাও সন্তানদের
দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা বলেন না। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের
গল্প শোনান না। এখন তারা বাচ্চাদের ‘হামপটি ডামপটি’ আর ‘বা বা ব্ল্যাক শিপ’ জাতীয় ইংরেজি
ছড়া শোনান। অনেককে গর্ব করে বলতে শুনেছি, ‘আমার খোকাখুকি ভালো করে বাংলা উচ্চারণ করতে
পারে না। তবে ইংরেজি বলতে পারে অনর্গল।’ কী অদ্ভুত! ২০১৭ সালের ১১ মার্চ ছিল আমাদের
শ্রীনগর (বিক্রমপুর) পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথির
বক্তব্যে তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামন নূর আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আজকাল
মায়েরা বাচ্চাদের বাংলা শেখান না, হিন্দি সিরিয়াল দেখান। আর সেজন্যই অনেক বাচ্চাকে
সকালবেলা বলতে শোনা যায়Ñমা, মুঝে নাশতা চাহিয়ে, স্কুল যানা পড়েগা।’ তিনি বলেছিলেন,
‘এভাবে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন করে বড় করছি।’
বস্তুত ভাষা আন্দোলনের মর্মার্থ অনুধাবনে ব্যর্থতাই এর প্রধান কারণ। আমরা ভাষা আন্দোলন, শহীদ দিবস এবং সাম্প্রতিককালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কেবল আনুষ্ঠানিকতার খাঁচায় বন্দি করে ফেলেছি। এর ব্যাপ্তি ও তাৎপর্য বিস্মৃতি হয়েছি। যার ফলে আমাদের আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দৈন্যদশায় উপনীত। বিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী আমরা পরিণত হয়েছি সাংস্কৃতিক ভিখিরিতে। এটা যে কত বড় লজ্জার, কত অপমানের এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রোজন। মনে রাখা দরকার, নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন জাতি কখনও টিকে থাকতে পারে না। স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে যদি আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে ভাষা আন্দোলনের বহুমাত্রিক তাৎপর্য অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হবে, হৃদয়ঙ্গম করতে হবে এর দাবি। অন্যথায় ভিন্ন সংস্কৃতি আমাদের গ্রাস করবে। এমনটি নিশ্চয় কাম্য হতে পারে না।