× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভাষার মাস

রাষ্ট্রের বিভাজনের রেখায় বাঙালির অর্জন

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৫২ পিএম

রাষ্ট্রের বিভাজনের রেখায় বাঙালির অর্জন

বহুভাষী ভারতের অনেক ভাষার মতো হিন্দিও আঞ্চলিক ভাষা। হিন্দি কেন ও কীভাবে ভারতের সরকারি ভাষায় পরিণত হলো? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পেছনে ফিরে যেতে হবে। ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয় বুর্জোয়ারা নিজেদের স্বার্থে এককেন্দ্রিক শাসনের পাশাপাশি এক ভাষা ও এক জাতির আওয়াজ তুলেছিল। তারা জাতি হিসেবে ভারতীয় এবং ভাষা হিসেবে হিন্দি ও দেবনাগরী লিপির হিন্দি ভাষাকে ভারতের সমগ্র জাতিসত্তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিল। ১৯১৫ সালে ভারতে ফিরে এসে মহাত্মা  গান্ধী সারা ভারত ভ্রমণ করেন। তখনই তিনি দেখতে পান ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিরা গোরক্ষা ও হিন্দি ভাষা প্রচলনে নানা তৎপরতায় লিপ্ত। তিনি  সে প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়ে যান। এ তৎপরতার মধ্য দিয়েই ভারতে গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। ১৯১৬ সালে কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘সর্বভারতীয় এক ভাষা ও এক লিপি সম্মেলন’ গান্ধীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়।

১৯১৯ সালে হিন্দি ভাষা প্রচারে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনের উপকমিটির সভাপতি হয়েছিলেন গান্ধী। ভারতীয় মাড়োয়ারি পুঁজিপতিদের অর্থের জোগানে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছিল। গান্ধীর হিন্দি ভাষা প্রচারাভিযানে মাড়োয়ারিদের পাশাপাশি গুজরাটি, পার্সি বণিকশ্রেণিও আর্থিক সহায়তা প্রদানে পিছিয়ে ছিল না। বাংলা ও আসাম প্রদেশে হিন্দি প্রচারাভিযানে ১৯২৮ সালে পুঁজিপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাকে কোষাধ্যক্ষ করে কলকাতায় হিন্দি প্রচারের এক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে হিন্দি ভাষাকে জাতীয় ভাষায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে সভাপতি করে হিন্দি সাহিত্য সম্মেলনে ‘রাষ্ট্রভাষা প্রচার সমিতি’ গঠিত হয়। পরে রাজেন্দ্রপ্রসাদ লিখেছিলেন, ‘এর নীতি স্বয়ং গান্ধীজি নির্ধারণ করেছিলেন এবং আমাদের শিল্পপতি বন্ধুরা অর্থের জোগান দিতেন।’

হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপি সমগ্র ভারতীয়র ওপর চাপানোর এ উদ্যোগে উত্তর প্রদেশের মুসলিম সম্প্রদায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা মনে করে হিন্দির দৌরাত্ম্যে তাদের উর্দু ভাষা-সংস্কৃতির বিলোপ ঘটবে। ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে লখনৌতে মুসলিম লীগ অধিবেশনে সমস্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ভারতের জাতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার নিন্দা জানান। হিন্দি ভাষার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন গান্ধী। গান্ধীও হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপির পক্ষে সম্প্রদায়গত বিভাজনের নীতি অনুসরণ করে সে বিভাজনকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন। অথচ গান্ধী নিজে হিন্দিভাষী ছিলেন না, তার মাতৃভাষা গুজরাটি।হিন্দি ভাষা ও দেবনাগরী লিপিকে জাতীয় ভাষা ও লিপির আন্দোলন অভিযানের ফলে দ্রুতই মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে গান্ধী-নেহরুরা মত পরিবর্তন করলেও উর্দুভাষী মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দি-উর্দু ভাষা বিতর্কে সরব হয়ে ওঠে এবং ভাষা নিয়ে সাম্প্রদায়িকতা তীব্র হয়। ১৯৩৭ সালের জুলাইতে কংগ্রেস সভাপতি নেহরু বলেন, ‘অবশ্যই হিন্দি অথবা হিন্দুস্থানি হচ্ছে জাতীয় ভাষা এবং হওয়া উচিতও। লিপি সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা দরকার যে, হিন্দি ও উর্দু দুই লিপিরই সহাবস্থান করা উচিত।... এ বিতর্ক বন্ধ করার জন্য ভালো হবে যদি আমরা কথ্য ভাষাকে হিন্দুস্থানি এবং লিপিকে হিন্দি অথবা উর্দু আখ্যা দিই। ইউরোপের প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর হিন্দিতে অনুবাদ হওয়া একান্ত দরকার।’ নেহরুর বক্তব্যটির সার কথা হচ্ছে হিন্দিই হবে ভারতের জাতীয় ভাষা। সেটা দেবনাগরী কিংবা উর্দু দুই লিপিতেই লিখিত হতে পারে। ভাষাপ্রশ্ন গ্রন্থে নেহরু লিখেছিলেন, ‘একমাত্র হিন্দুস্থানিই সমগ্র ভারতের ভাষা হতে পারে।’

গান্ধী মুসলমানদের বিরোধিতার মুখে হিন্দুস্থানি কথ্য ভাষার অনুরাগী হয়ে ১৯৪২ সালে ‘হিন্দুস্থানি প্রচার সভা’ সংগঠন গড়ে তোলেন। উত্তর ভারতে কথ্য ভাষা রূপে হিন্দুস্থানি ভাষা ছিল বটে, তবে সেটি হিন্দি ও উর্দুর সংমিশ্রণে গঠিত। লিপি না থাকায় লিখিত ভাষারূপে হিন্দুস্থানি ভাষার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের সংবিধান সভায় গান্ধী প্রস্তাব করেছিলেন, তারাই সংবিধান সভার সদস্য হতে পারবেন যারা হিন্দি ভাষার সঙ্গে পরিচিত। গান্ধী আরও দাবি করেন, ভারতের সংবিধান হিন্দুস্থানি ভাষায় লিখিত হতে হবে। উদ্দেশ্য ছিল দেবনাগরী লিপির বাতাবরণে হিন্দি ভাষাকেই সমগ্র জাতিসত্তার কাঁধে চাপানো। বাস্তবতা হচ্ছে, হিন্দুস্থানি ভাষা প্রকৃতই কথ্য ভাষা। সে ভাষার লিপি ছিল না, সাহিত্যও ছিল না। হিন্দুস্থানি ভাষার দাবিটি ছিল হিন্দি ভাষা প্রতিষ্ঠায় কৌশলমাত্র।

১৯৪৭ সালে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হওয়ার আগে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভারতের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে কোনো ধারা রাখা হয়নি হিন্দি ভাষা উত্থাপনে বিতর্ক-বিভক্তির আশঙ্কায়। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান বি আর আম্বেদকর বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস হিন্দি ভাষার ধারা নিয়ে যতটা বিতর্ক করেছে, অন্য কোনো ধারা নিয়ে অতটা বিতর্ক করেনি।’ সংবিধান সভায় কংগ্রেসের সদস্যদের মনোনীত করেছিলেন জওহরলাল নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। জাতীয় ভাষা নির্ধারণের ভোটাভুটিতে হিন্দির পক্ষে ৭৮ এবং হিন্দির বিপক্ষে ৭৮ ভোট পড়ে। সমাধানের লক্ষ্যে পুনরায় ভোটাভুটিতে হিন্দির পক্ষে ৭৯ ও বিপক্ষে ৭৭ ভোট পড়ে। মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে হিন্দি ভাষা ভারতের সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করে। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং দলীয় নির্দেশা অনুযায়ী সংবিধান সভায় হিন্দি-অহিন্দি কংগ্রেস সদস্যরা হিন্দির পক্ষেই ভোট প্রদান করেছিলেন। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতির সচিব সি এস ভেঙ্কটাচার লিখেছেন, ‘হিন্দি ভাষার প্রশ্নে চরমপন্থার অশুভ তাৎপর্য মুসলিম সম্প্রদায়কে যথার্থই আতঙ্কিত করেছিল। মুসলমানরা উপলব্ধি করেছিল তাদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন। এ বিশ্বাস দ্রুত মুসলমান সম্প্রদায়ের মনের ওপর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপেই পাকিস্তান সৃষ্টিতে এটি অন্যতম মুখ্য কারণ হয়েছিল।’

ভাষার দ্বন্দ্বে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের বিভক্তি সাম্প্রদায়িক বিভক্তিরই অনুষঙ্গ। দেশভাগ, রক্তাক্ত দাঙ্গা, উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ, উৎপাটনের ইতিহাস উপমহাদেশের সর্বাধিক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। ভারত-পাকিস্তান দুই দেশে হিন্দি-উর্দু ভাষা সরকারি এবং রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু  পাকিস্তানের পূর্ববাংলায় অর্থাৎ এই ভূখণ্ডে উর্দু ভাষা চাপানো সম্ভব হয়নি। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছিল।ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায় হয়ে আছে বায়ান্নর মাতৃভাষা আন্দোলন।  আমাদের গৰ্ব্ব , বাঙালি অধিকার ও ন্যায়ের প্রশ্নে কখনওই আপস করেনি। বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক মোরেস বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের ঐক্য যদি কৃত্রিম ছিল তো ভারতবর্ষের দেশভাগও তাই। ভারতবর্ষকে যদি বিভক্তই হতে হতো, তবে জনতত্ত্বগত এবং সাংস্কৃতিক সংহতি ও ভাষার ভিত্তিতে যুক্তিসম্মতভাবে ভাগ হওয়া উচিত ছিল।’


  • নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা