সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৩৯ এএম
পার্বত্যাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যালঘু জাতিসত্তার
মানুষ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে
উঠে আসে। প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এবারও এ ধরনের প্রতিবেদনের দেখা
মিলেছে। যেখানে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষা হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথাই ব্যক্ত হয়েছে।
আমাদের পার্বত্যাঞ্চলে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ ১১টি ভাষাভাষী ১৪টি জাতি গোষ্ঠীর বাস।
তাদের সবারই রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা। আবার সীমান্তবর্তী শেরপুর জেলায় গারো, কোচ, হাজং,
বর্মণ, বানাই, হদি, ডালুসহ সাতটি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার বাস। তাদেরও প্রত্যেকের রয়েছে
নিজস্ব ভাষা। অথচ যথাযথ পরিচর্যা এবং নিজস্ব বর্ণমালায় এসব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের
পড়ালেখার যথেষ্ট সুযোগ নেই। ফলে তাদের নিজস্ব ভাষাগুলোর হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে আশার কথা, সরকার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুরা যেন স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করতে
পারে সে উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য ইতোমধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় শিশুদের প্রাক্-প্রাথমিক
থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে সরকার উদ্যোগ
নিলেও স্থানীয় পর্যায়ে নানা প্রতিবন্ধকতায় এ ধরনের উদ্যোগ আলোর মুখ না দেখার কথাও সংবাদমাধ্যমেরই
প্রতিবেদনে উঠে আসছে। যা ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষা হারিয়ে যাবার
ইঙ্গিতবাহী। আমরা জানি, আধুনিকতা এবং বিশ্বায়নের সুযোগ বিশ্বের অসংখ্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর
ভাষাই আজ হুমকির মুখে। এর পেছনে একদিকে যেমন অনেক জাতিগোষ্ঠীর ভাষার কথ্যরূপ থাকলেও
নিজস্ব বর্ণমালা না থাকা দায়ী তেমনি, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অগ্রসর জাতির ভাষার
আগ্রাসানও দায়ী। এর সঙ্গে মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু না হওয়া বাড়তি উপসর্গ হিসেবে
যোগ হয়েছে। ফলে মাতৃভাষা ভুলে যাচ্ছে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার অনেকেই।
বিশ্বায়নের এই যুগে ভাষার প্রচার-প্রসার যেকোনো জাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে বিশ্বায়ন সম্পর্কে আমাদের মধ্যে একধরনের অপধারণা গড়ে উঠেছে, প্রতিযোগিতায় টিকে
থাকতে হলে শিখতে হবে বিদেশি ভাষা। বিশেষভাবে বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতি এমনকি বাণিজ্যের
আদান-প্রদানে টিকে থাকার জন্য ইংরেজি শিখলেই হয়, এমন ধারণাও অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে
আছে। বাঙালির ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার্জনের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বলেছিলেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।’ ভাষার সঙ্গে
জড়িয়ে থাকে সমাজবাস্তবতা, সংস্কৃতি এবং জাতিগত চেতনাও। সেই সত্যটিকে ধারণ করেই মাতৃভাষার
প্রসারে জোর দেওয়া জরুরি। আজকে শুধু সংখ্যালঘু জাতিসত্তাই নয়, বাংলা ভাষার প্রচলনও
আমরা সর্বস্তরে করতে পারিনি। বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একাত্তরে
মুক্তিযুদ্ধপর্বের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন বাংলাদেশ। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি
আজ শুধু শহীদ দিবস নয়, জাতিসংঘের ইউনেস্কোর স্বীকৃতির মাধ্যমে দিনটি এখন বিশ্বব্যাপী
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। একুশের মূল চেতনা ছিল মাতৃভাষার অধিকার
সংরক্ষণ করা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পরিমার্জন, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের
লক্ষ্যে গড়ে তোলা হয় একাধিক প্রতিষ্ঠান। দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতিষ্ঠান গড়া হলেও তার
অধিকাংশকেই আজও শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের
বিরুদ্ধে মাতৃভাষার অধিকার সংরক্ষণে মনোযোগের অভাবের অভিযোগ রয়েছে। রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক
সচেতনতা ও ভাষার সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগের অভাবও। আমরা মনে করি, ভাষার ক্ষেত্রে সব
প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে অগ্রণী
ভূমিকা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার যেমন নিশ্চিত করতে হবে তেমনি সব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর
ভাষা সংরক্ষণেও যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ২৩ নম্বর
ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার
বিকাশ ঘটানোর কথা’ এবং একই শিক্ষানীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ে (প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক
শিক্ষা) ‘আদিবাসী শিশু’ শিরোনামের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আদিবাসী শিশুরা যাতে
নিজেদের ভাষা শিখতে পারে, সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা
করা হবে।’ আমরা জানি, সরকার এই শিক্ষানীতির আলোকেই কয়েকটি ভাষার প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার
বই প্রকাশ করেছে। তবে তা যে যথেষ্ট নয়, এ কথা লেখাই বাহুল্য। মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার
প্রতিটি শিশুর। আর তাই সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর যেসব ভাষায় এখনও শিক্ষা কার্যক্রম
চালু হয়নি, সেসব ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর তাগিদ দিই আমরা।
একই সঙ্গে আমরা এ-ও বলতে চাই, কোনো
ভাষার চাপে বা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারিয়ে না যাক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা।
ভাষাবিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট এথনোলগের মতে, বর্তমান পৃথিবীতে বেঁচে থাকা
ভাষার আনুমানিক সংখ্যা ৭ হাজার ৯৭টি। যাদের মধ্যে ২ হাজার ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা
১ হাজারের কম। এ ছাড়া মোট ভাষার মাত্র অর্ধেকের রয়েছে লিখিত রূপ।
আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছি। বুকের রক্ত
দিয়েছি। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা যেমন আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তেমনি অন্যান্য
সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষাও আমাদের কাছে সমান মর্যাদা ও গুরুত্বের। আমরা মনে
করি, উন্নত বাংলাদেশ গড়তে সবার আগে প্রয়োজন মাতৃভাষার চর্চা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও সুরক্ষা
প্রদান। লেখায়, বলায়, পঠন-পাঠনে সর্বত্র বাংলাকে যেমন প্রতিষ্ঠা করতে হবে মর্যাদার
আসনে তেমনি অন্যান্য ভাষার প্রতিও দিতে হবে সমগুরুত্ব। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য তখনই
তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, যখন দেশের সব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণের কাজ আমরা
যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে পারব।