স্থানীয় সরকার নির্বাচন
ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৩৬ এএম
ড. মোসলেহউদ্দিন আহমেদ
উপমহাদেশে এখন
পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের সুসংহত কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি- এ অভিযোগ নতুন নয়। ১৮৮২
সালে লর্ড রিপন স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় স্বশাসন।
খানিকটা ইউরোপের স্থানীয় সরকারের আদলেই গড়ে তোলা এই কাঠামো আধুনিক সময়ে পরিপূর্ণতা
তো পায়ইনি বরং অনেকাংশে পথচ্যুত হয়েছে। স্থানীয় সরকার কাঠামোর মূল কাজ শুধু স্থানীয়
অবকাঠামোর উন্নয়ন নয়। এই কাঠামোর সরকার স্থানীয় পর্যায়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে।
স্থানীয় সরকার যেন এখন সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে।
এ প্রত্যাশা মোটেও অমূলক নয়, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী ও চৌকস করে তোলা গেলে বিদ্যমান
রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রবিশেষে অর্থনৈতিক সমস্যার নিরসন দুরূহ কিছু হতো না। উল্লেখ্য,
সরকার স্থানীয় সরকারের জন্য যে বরাদ্দ থাকে তা মূলত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ইউএনডিপি ও জাইকা,
কিংবা অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে সংগ্রহ করে দেয়া হয়। স্থানীয় সরকার কর আদায় কিংবা
সরকার পরিচালনার স্বতন্ত্র পদ্ধতি অনুসরণ করে না। শুধু তাই নয়, যে ধরনের ব্যবস্থা এখনও
টিকে আসছে, সেক্ষেত্রে স্থানীয় শাসন পরিচালনার পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয় না। বরাদ্দ
সংগ্রহ এবং কেন্দ্রীয় নির্দেশ অনুসারে কাজ করাকে স্থানীয় শাসন বলা চলে না। স্থানীয়
সরকার ব্যবস্থার পুনঃসংস্কার নিয়ে অতীতে বহুবার এই স্তম্ভেই লিখেছি। কিন্তু এবার আমরা
দেখতে চাই বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট ও স্থানীয় সরকার কাঠামোর অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে।
শহর-গ্রামে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের হাওয়া
বইতে শুরু করেছে। আমরা জানি, মার্চ মাস থেকে স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের
নির্বাচন হতে যাচ্ছে এবং ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবার দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করবে না
বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিধান তারাই করেছিল।
বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক বলেই মনে করি। রাজনীতিতে
প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকারণ যাচাই করতে পারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতার
কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে রাজনৈতিক সংকট এড়ানো সহজ কিংবা সম্ভব হয়। আমরা দেখেছি,
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রচারপর্বে অনেক প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক
সংঘাত-সহিংসতায় জড়িয়েছেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওই সংঘাত-সহিংসতামূলক ঘটনা ঘটেছে নিজেদের
মধ্যে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন দিলে প্রার্থী বাছাই
এবং মনোমালিন্য সৃষ্টির শংকা এবার আরও বেশি ছিল। স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন হওয়ায় এ
ধরনের নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। আবার স্থানীয় পর্যায়ের হওয়ায় এ ধরনের
নির্বাচনে প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার মানসিকতাও থাকে প্রবল। স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনে
সবার অংশগ্রহণ আওয়ামী লীগ অবাধ করে দিয়েছে। ফলে যে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে যুক্ত
হতে পারবেন। দল থেকে যখন আর কোনো বাধা থাকছে না এবং দলীয় প্রতীকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে
প্রার্থী দেবে না, ফলে নানা শঙ্কা অনেকাংশে দূর হয়ে গেছে।
দলীয় প্রতীকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে প্রার্থী
না দেওয়ার আরেকটি বিষয় ভেবে দেখা জরুরি। স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে
বিএনপি কিংবা জাতীয় পার্টি দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাছাড়া জাতীয়
পার্টিতে গৃহদাহ আবার দেখা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দলটি নতুন সংকটে পড়েছে। দ্বাদশ জাতীয়
নির্বাচনের আগে ওই নির্বাচনকে বয়কট করেছিল বিএনপিসহ সমমনারা। স্থানীয় সরকার কাঠামোর
নির্বাচনেও দলীয়ভাবে তারা অংশ নেবে না, এমনটি নিশ্চিত। দলটির শীর্ষপর্যায় কিংবা হাইকমান্ড
থেকেও নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দ্বাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী দল বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নেবে কি না, তা অনিশ্চিত নয়, বরং বলা
যায় নির্বাচনে অংশ নেবে না এটা নিশ্চিত। কিন্তু দলের নেতাকর্মীরা দলের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে
অংশ নেবেন, এমনটি সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। তবে বিএনপি তাদের এই সিদ্ধান্তে অনড় থাকবে,
সংবাদমাধ্যমের নানা সূত্রে এমনটি স্পষ্ট। দলটির বর্তমান অবস্থান এবং পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত
যাচাই করলে এই সিদ্ধান্তের প্রাসঙ্গিকতা বোঝা যায়। যেহেতু বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে অংশ নেয়নি এই যুক্তিতে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন
সম্ভব না, সেহেতু স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনেও অংশ নেওয়ার বিষয়টি তারা ভাবছে না।
নির্দলীয়ভাবে যাতে সবাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয় মুখ্যত এই চিন্তা থেকেই আওয়ামী
লীগ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
যদি বিএনপি বা সমমনারা দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার
কাঠামোর নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়, তাহলে পূর্ববর্তী দাবিগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক
হয়ে উঠবে। এমনকি বিএনপির সমর্থকদের কাছেও ভিন্নবার্তা পৌঁছতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
অংশ না নিয়ে স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যুক্তিসংগত কারণ ভোটাররাও
খুঁজে পাবেন না। তবে বিএনপি বা তাদের সমমনাদের স্থানীয় পর্যায়ের অনেকেই এই নির্বাচনে
দলীয় পরিচয়ের বাইরে নির্বাচনে অংশ নেবেন এমনটি ধারনা করা যায়। আগেই বলেছি, স্থানীয়
সরকার কাঠামো অনেকাংশে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীল। সরকারের সঙ্গে
সমঝোতা ব্যতীত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি হিসেবে টিকে থাকাও কঠিন। সরকার যেকোনো কারণ
দেখিয়ে যেকোনো সময় স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির পদ বাতিল ঘোষণা করতে পারে, এমনটি স্থানীয়
সরকার আইনেই স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দলটি এমন
সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় বিএনপির ভেতর নানামুখী
স্রোত বেগবান হয়ে উঠেছে। দলটি এ মুহূর্তে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা
মনে হচ্ছে না। রাজনৈতিক বাকবদল এবং দলীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের
অসন্তোষ এক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, এমন অভিযোগও নানা মহল থেকে ইতোমধ্যে মিলেছে।
বিদ্যমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দলটি কীভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে সেটিই
এখন দেখার বিষয়।
আবারও বলি, মোটামুটি পরিষ্কারভাবেই ধারণা করা
যায়, দলীয় প্রতীক থাকুক কিংবা না থাকুক সব দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাই স্থানীয় সরকার
কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। সম্প্রতি প্রতিদিনের বাংলাদেশের
একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে নির্বাচনে স্থানীয়
রাজনীতিক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভিন্নমাত্রায়। আবার স্থানীয় সরকার নির্বাচনই তৃণমূল
পর্যায়ে নির্বাচনী আমেজটা উৎসব আকারে দেখা দেয়। এই নির্বাচন সব সময়ই উৎসবমুখর হয়। কারণ
যারা প্রার্থী তাদের সম্পর্কে ভোটারদের স্পষ্ট ধারণা থাকে। আবার প্রার্থীরাও ভোটার
সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন। প্রার্থী ও ভোটারের মধ্যকার যোগসূত্রের কারণে ভোটার উপস্থিতি
থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ পর্ব সম্পন্ন হয় উৎসবমুখর পরিবেশে। তবে আমাদের সবচেয়ে বড় তিক্ত
অভিজ্ঞতা হলো, স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে সহিংসতা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার
বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিগত কয়েকটি নির্বাচনেও এই উদ্বেগজনক চিত্রই উঠে এসেছে। এমনটি
হওয়ার পেছনে স্থানীয় সরকার অবকাঠামোর অভাব প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। স্থানীয় সরকার কাঠামোয়
প্রতিনিধি যিনি নিযুক্ত হন, তাকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে কাজ করতে হয়।
আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, স্থানীয় সরকার কাঠামোর নির্বাচনে বিরোধী কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীও জয়ী হয়েছেন বিপুল ভোটে। তারা দায়িত্বপ্রাপ্তির পর সঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় একদিকে স্থানীয় ভোটাররা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং অন্যদিকে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এমন নজিরও রয়েছে। অর্থাৎ যারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারবেন তারা এখানে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রার্থীরা জয়ের জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বলা হচ্ছে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে না। তারপরও যারা প্রার্থী তাদের অনেকেই পেশিশক্তির প্রয়োগে আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করবেন, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, এজন্য সমন্বয়মূলক পথ অনুসরণ করতে হবে। অতীতে স্থানীয় সরকার কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতার অনেক মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছে। অভিজ্ঞতার আলোকে নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে আগাম ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অধিকারের মাঠ সমতল, প্রশ্নমুক্ত নির্বাচন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই চ্যালেঞ্জগুলো যেহেতু রয়েছে সেহেতু এই নিরিখেই ব্যবস্থা নিতে হবে।