আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
হারুন হাবীব
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:১৭ পিএম
ঢাকার বুকে বাংলা
ভাষার মর্যাদা রক্ষায় যে বাঙালি যুবকরা পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে জীবন দিয়েছেন, তাদের
আত্মত্যাগ বিশ্ব স্বীকৃত হয়েছে, ২১ ফেব্রুয়ারি সব মানুষের ভাষার দিনে পরিণত হয়েছে।
অর্থাৎ বাংলা ভাষা আন্দোলনের সফলতা বহুভাষাবাদ ও বহুসংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। এ কারণে
২১ ফেব্রুয়ারি যদিও বাঙালির এবং বাংলাদেশের, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত
হওয়ার পর থেকে দিনটি বিশ্ববাসীর। ১৯৫২ সালের এদিনে (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার)
সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে
মিছিলরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ঘটে; শহীদ হন রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাম,
বরকতসহ আরও কয়েকজন। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র কয়েক মাসের মাথায় দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর
ভাষা উপেক্ষা করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা পূর্ববঙ্গের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে। প্রতিবাদে
তারা ফেটে পড়ে। ফলে ধর্মজাতীয়তার মোহ ডিঙিয়ে ভাষাজাতীয়তার উন্মেষ ঘটে এবং তা হয়ে ওঠে
বাংলাভাষীর প্রবল এক আত্ম-অন্বেষণ।
বাংলা ভাষার আন্দোলনের
শুরু পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই। তবে এর চূড়ান্ত বিস্তার ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজিকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি
দেওয়া হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ
মানুষের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গ্রহণ করার প্রস্তাব দেন। তার
প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়। শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের
১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক
সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের হাত ধরে। এর পরম্পরায় ২৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা
সংগ্রাম পরিষদ। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা স্বীকৃতিদানের দাবিতে ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার
সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২১ মার্চ, ১৯৪৮-এ রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলি
জিন্নাহ এক নাগরিক সংবর্ধনায় ঘোষণা করেনÑ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’।
সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্রজনতা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করে। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার
দাবি পুনরায় নাকচ করেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু,
একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে।’ পাকিস্তানের জাতির পিতার এ বক্তব্য
সমাবর্তনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ছাত্ররা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে। জিন্নাহর
বাংলাবিরোধী এ অবস্থানের ফলে ভাষা আন্দোলন আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
ওই আন্দোলনের
আরেক পর্ব আসে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বাংলাদেশের স্থপতি
ও ভাষাসংগ্রামী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘মাতৃভাষার অপমান কোন
জাতি সহ্য করতে পারে না। পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ছাপ্পান্ন জন বাংলা ভাষাভাষী হয়েও
শুধুমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বাঙালিরা করতে চায় নাই। তারা চেয়েছে বাংলার সাথে উর্দুকেও
রাষ্ট্রভাষা করা হোক, তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু বাঙালির এই উদারতাটাই অনেকে দুর্বলতা
হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।’ (পৃষ্ঠা ১৯৮)। তিনি আরও লিখেছেন : ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র
চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং
তমদ্দুন মজলিস এর প্রতিবাদ করল এবং দাবি করল, বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা
করতে হবে। আমরা সভা করে প্রতিবাদ শুরু করলাম। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
এবং তমদ্দুন মজলিস যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে একটা “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”
গঠন করল। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে “বাংলা ভাষা দাবি” দিবস ঘোষণা করা হল। জেলায় জেলায়
আমরা বের হয়ে পড়লাম।’ (পৃষ্ঠা ৯১, ৯২)।
বাংলা ভাষার সংগ্রাম
একই সঙ্গে দুটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত করে। প্রথমটি, যে বাঙালি মুসলমান ধর্মজাতীয়তার মোহে
পাকিস্তান সৃষ্টির পথে বড় ভূমিকা রাখে তারা ধর্মীয় বিভাজনের কুফল অনুভব করে। অন্যদিকে
যে বাঙালি হিন্দু পাকিস্তান সৃষ্টিতে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তারাও ধর্মজাতীয়তার
পথ থেকে ভাষাজাতীয়তার পথে হাঁটে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের পর সর্বস্তরের মানুষ
প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। বলা বাহুল্য, ঢাকার বুকে ভাষাসংগ্রামীদের রক্তপাত ভাষাজাতীয়তা
সামনে এগিয়ে দেয়। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাঙালি ধর্মচেতনার
বাইরে বেরিয়ে জাতিচেতনা আঁকড়ে ধরে। ফলে মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান
প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পাকিস্তান সৃষ্টিকারী মুসলিম লীগ দলটি পরিপূর্ণভাবে বাঙালি
জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টের কাছে পরাজিত হয় এবং বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার বাংলাকে পূর্ব
পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়। এরপর পাকিস্তানি শাসকচক্র ১৯৫৬ সালের
২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান
পাস করে। ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন শুরু হয় ১৯৫৩ সালে। এদিন সূর্য
ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণ করে এবং ঢাকা মেডিকেল
কলেজ প্রাঙ্গণে গড়ে তোলা শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য
অর্পণ করে। শোকের চিহ্নস্বরূপ তারা কালো ব্যাজ ধারণ করে।
২১ ফেব্রুয়ারি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতিরও একটি সংগ্রাম আছে। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে
বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম এর মূল উদ্যোক্তা। এ দুই বাঙালি নিজ
উদ্যোগে ১৯৯৮ সালে দিনটির স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানান জাতিসংঘের তখনকার মহাসচিব কফি
আনানের কাছে। পরে তারা ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন
দাঁড় করান যার পক্ষ থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাবিটি উত্থাপিত হতে থাকে। ১৯৯৯
সালে এরা ইউনেস্কোর শরণাপন্ন হন। বাংলাদেশ সরকার তাদের উদ্যোগে সমর্থন জানায়। ভারতসহ
আরও কিছু দেশও সমর্থন দেয়। ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাবটি
স্বীকৃত হয় ১৮৮টি দেশের সমর্থনে।
২০১০ সালের ৩
নভেম্বর জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের
প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ সমর্থন বাংলা ভাষার প্রতি
বিশ্ববাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সম্মান প্রদর্শনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। বাংলা
আজ বিশ্বের ৩০ কোটি মানুষের ভাষা, বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। এ ভাষা যেমন বাংলাদেশের
মানুষের তেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের বরাক উপত্যকার মানুষের। এর বাইরেও
বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোটি প্রবাসী বাঙালির। বাংলাদেশের আপামর মানুষ
প্রতি বছর অমর ২১ শহীদ দিবসে ভাষা আন্দোলনের সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ
করে। এ স্মরণ একই সঙ্গে ঘটে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ সারা বিশ্বে। তবে বাংলাদেশের
উদ্যাপন ভিন্ন জ্যোতিতে ভাস্বর। কারণ অমর একুশে বাংলাদেশের মানুষকে আত্মত্যাগের মন্ত্র
শিখিয়েছে, যে মন্ত্র জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসাম্প্রদায়িক
চেতনায় ভাস্বর। এ ভাষাশহীদদের পবিত্র রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশে আছে পূর্ববঙ্গ বা সাবেক
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পত্তনের ইতিহাস।
কালের বিবর্তনে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দুর্জয় অনুপ্রেরণার
চির-অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে ভাস্বর হয়েছে। বাংলা ও বাঙালির জন্য যা গৌরবের।
বাংলাদেশের মানুষের
কাছে ২১ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রত্যয়ের দিন, আত্মপরিচয় অন্বেষণের দিন, শুধু মাতৃভাষা রাষ্ট্রভাষার
মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দিন নয়। কারণ পাকিস্তানি শাসকদের হাতে বাংলা ভাষা, বাংলা
সংস্কৃতি এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন! ওই ষড়যন্ত্র
রুখতে হয়েছে পূর্ববঙ্গের মানুষকে। এ কারণে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ২১ ফেব্রুয়ারি
বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে মহিমান্বিত চিরভাস্বর দিন; যা ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের
বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ ও জাতীয় চেতনার উন্মেষের দিন, জাতিসত্তার শেকড় সন্ধানের
দিন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে প্রথম বিশ্বায়নের উদ্যোগ নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ উদ্যোগের প্রথম বাস্তবায়ন ঘটে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। তখন বিশ্বসংস্থার কার্যক্রম পরিচালিত হতো মূলত পাঁচ ভাষায়। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক সব রীতি উপেক্ষা করে ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দান করেন। ফলে বাংলা ভাষার বিশ্বস্বীকৃতি ঘটে। রাষ্ট্রগতভাবে বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের সফল উপস্থিতি এ স্বীকৃতির কারণ। অন্যদিকে ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট বাংলাকে স্বীকৃতির বিল পাস করে। ফলে বাংলা ভাষার বিস্তার অব্যাহত আছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও লন্ডনে বাংলা ভাষার সরকারি প্রচলন ঘটেছে বিপুলসংখ্যক বাঙালি অভিবাসীর কারণে। বিশ্বের বহু দেশের কমপক্ষে ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ, সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি শিক্ষার্থী বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেন।