প্রেক্ষাপট
আর কে চৌধুরী
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:১১ পিএম
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সচেতনভাবে
বাঙালির কাছ থেকে ভাষার অধিকার হরণ করতে চেয়েছিল। তারা চেয়েছিল সংখ্যালঘু জনগণের ভাষা
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর বিরুদ্ধে
গর্জে ওঠেন। আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে,
১৯৪৮ সালে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম
ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় ভূমিকা রাখেন। এক কথায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও
মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত। ১৯৪৭ সালে
দেশ বিভাগের পর মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হন। এ সময় নবগঠিত
দুটি প্রদেশের মধ্যে পূর্ব বাংলার প্রতি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ভাষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে
বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। ফলে শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের
জন্মের পরপর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী কর্তব্য নির্ধারণে
সমবেত হয়েছিলেন কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক
আন্দোলন ও সংগঠন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন
শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের
কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব গৃহীত
হয়।
এ প্রসঙ্গে গাজীউল হক ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ
করেন, ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর
রহমান।’ প্রস্তাবগুলো ছিল, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের
ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত
গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত
হউক।’ এভাবেই ভাষার দাবি বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান ভারত থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনে শরিক
হন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাসংগ্রামী সর্বপ্রথম ভাষা
আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবিসংবলিত ২১ দফা নিয়ে একটি ইশতেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইশতেহারে
২১ দফার মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ঐতিহাসিক এ ইশতেহারটি একটি ছোট
পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইশতেহার-ঐতিহাসিক দলিল’।
ওই পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
এ ইশতেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম
স্বাক্ষরদাতা।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি ১৯৫০ সালে গ্রেপ্তার হন। বন্দি থাকা অবস্থায়ও ছাত্রদের সঙ্গে সব সময় তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি জেল থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দিতেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি পুরান ঢাকার কে এল জুবলি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। তখন আমাদের শ্রেণীশিক্ষক ছিলেন কামরুজ্জামান স্যার। তিনি পরে যুক্তফ্রন্ট থেকে মনোনয়ন নিয়ে এমপি হন। পরে স্কুলটি কলেজে রূপান্তরিত হলে প্রিন্সিপাল হন। তিনি সারা দেশের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। কামরুজ্জামান স্যার ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ক্লাস ক্যাপ্টেন হওয়ায় স্যারের সঙ্গে আমার সখ্য ছিল। স্যারের নেতৃত্বে আমরা একাধিকবার মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিও আমরা মিছিলসহকারের ভাষা আন্দোলনের জনসভায় যোগ দেই। ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য।