আবদুল মান্নান
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:০৯ পিএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:১৩ পিএম
অলংকরণ প্রবা
একসময় প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস বা রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা বেশ ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করত। তেমনটি আজ দেখা যায় না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। বিশ্বে এমন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আর কোনো রাষ্ট্র পাওয়া যাবে না। ১৯৯৯ সালে দিনটিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিদেশে দিনটিকে শুধু মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দেখা হবে, অন্য কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ দিনটি দেখতে হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকবদলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে। দেখতে হবে বাঙালির নবজাগরণের প্রভাত হিসেবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা, যা পরিপূর্ণতা লাভ করে ১৯৭১ সালে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে কজন ব্যক্তি এ দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দেশ ও জাতির সঙ্গে পথ চলেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
যাদের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, বাঙালি মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে তাদের দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস শেষ হবে। শুরুতে এ কারণেই অবিভক্ত বাংলাকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চিন্তা করা হয়েছিল। অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা কেন হয়নি তা অন্য প্রসঙ্গ। অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা যখন হচ্ছে না, তখন বাংলাকে ভাগ করার বিষয়টিই চূড়ান্ত করলেন অপরিণামদর্শী রাজনীতিবিদরা। প্রচলিত কথা হচ্ছে দেশভাগ বা ভারত ভাগ। আসলে ভারত তো ভাগ হয়নি, ভাগ হয়েছে বাংলা আর পাঞ্জাব, তা-ও সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে।
যারা মনে করেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পূর্ব বাংলার শোষিতদের ভাগ্য বদলাবে, তাদের সে ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। এক বছরের কম সময়ে এ দেশের শিক্ষিত যুবসমাজ ও পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য যেসব বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা লড়াই-সংগ্রাম করেছিলেন, তারা বুঝতে পারেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকগোষ্ঠী ভাষাকে শোষণ ও শাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
একটি দেশের যদি রাষ্ট্রভাষা বলে কিছু থাকে, তাহলে তা হওয়া উচিত সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা। ভারতের কোনো রাষ্ট্রভাষা নেই, আছে দুটি দাপ্তরিক ভাষা হিন্দি আর ইংরেজি। এর বাইরে তাদের কমপক্ষে ২৩টি আঞ্চলিক ভাষা আছে এবং প্রতিটি রাজ্য চাইলে তাদের দাপ্তরিক কর্ম ওই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষায় পরিচালনা করতে পারে। ইউরোপেরও কোনো দেশে রাষ্ট্রভাষা নেই, আছে দাপ্তরিক ভাষা। ভাষাকে পাকিস্তানে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির অনেক আগেই এবং তাতে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন উত্তর ভারতের উর্দু জানা মুসলিম লীগের সমর্থক বা নেতারা।
পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগোষ্ঠীর আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ পায় দেশটির সৃষ্টির কয়েক মাস পর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের বড়লাট বা গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তাকে দেওয়া এক সংবর্ধনায় ইংরেজি বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, ‘উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। রেসকোর্স ময়দানেই প্রতিবাদ হলো জিন্নাহর ঘোষণার বিরুদ্ধে। সেদিন যারা জিন্নাহর ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের বেশিরভাগই তরুণ। অনেকে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কার্জন হলে আয়োজিত এক বিশেষ সমাবর্তনেও জিন্নাহ রেসকোর্সের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন। উপস্থিত ছাত্ররা তীব্র এর প্রতিবাদ করেন। ছাত্ররা প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিলেন এবং ঠিক তা-ই করেন, যাদের মধ্যে তরুণ শেখ মুজিবও ছিলেন। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জিন্নাহ বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে সভাস্থল ত্যাগ করেন। বলতে গেলে জিন্নাহর অপরিণামদর্শী বক্তব্যই পাকিস্তানের কফিনে প্রথম পেরেক ঠোকে। জিন্নাহর পথ ধরে পরে তার উত্তরসূরি ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিন আর উত্তর প্রদেশ থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে আসা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ও পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনও একই বক্তব্য দেন; যার প্রতিবাদ করে বাংলার মানুষ।
তরুণ শেখ মুজিব জানতেন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে চাই জনগণের সংগঠন। তাই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। বাস্তবে ছাত্রলীগই ছিল নব্যসৃষ্ট পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, সামনের কাতারে থেকে তার নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্র ও যুব সংগঠন। ১৯৪৯ সালে তরুণ শেখ মুজিবের প্রচেষ্টায় গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ‘আওয়াম’ শব্দটির অর্থ জনগণ। মুসলিম লীগ ছিল উচ্চবিত্তদের সংগঠন। সেখানে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। সুতরাং মুসলিম লীগের বিপরীতে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করানোর অর্থ হচ্ছে এবার জনগণের একটি সংগঠন হলো, যারা জনগণের কথা বলবে। সৃষ্টির পর থেকে আওয়ামী লীগ তা-ই করেছে বা চেষ্টা করছে। পরে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়া হয়, যাতে সংগঠনটি একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটিতে শেখ মুজিবকে করা হয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তখন তিনি কারাগারে।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একপর্যায়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রমিছিলে পুলিশের গুলি চলে, গুলিতে ছাত্রহত্যার পরই পাকিস্তানের রাজনীতির বাঁক আবার পরিবর্তন হয়। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। এ নির্বাচন পূর্ব বাংলার জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম লীগ আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগসহ পূর্ব বাংলার সব রাজনৈতিক দল মিলে গঠিত যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নির্বাচনে মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসনে জয় লাভ করে। ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনই ছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা রাজনৈতিক দল জিন্নাহর মুসলিম লীগের পরিসমাপ্তি। সেই যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন, তা থেকে ওই দলটি আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সেখানেই শুরু বাঙালির একটির পর একটি রাজনৈতিক বিজয়গাথা, যার নেতৃত্বে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব, যিনি পরে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরে এসেছে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, যার নেতৃত্বে যথারীতি ছিল দেশের ছাত্রসমাজ। শিক্ষা আন্দোলনের ফলে পাকিস্তান সরকার শরিফ কমিশন শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর ১৯৬৮ সালে সূচিত হয় আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। তখন আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিয়ে কারাগারে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় দেশের ছাত্রসমাজ। আন্দোলনের তোড়ে ভেসে যায় পাকিস্তানের লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খান। এটি ছিল জিন্নাহর পাকিস্তানের শেষ বাঁক পরিবর্তন। আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়লেন আরেক সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে। তারপর সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয়। এত কিছুর পরও পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালিদের চিনতে ভুল করে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করে। তারপর আমাদের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বাঙালির নতুন ইতিহাসের যে যাত্রা ১৯৪৮ সালে, তার পরিসমাপ্তি ১৯৭১ সালে। ১৯৪৮, ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১Ñনয়টি পর্বে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিটি বাঁক পার হওয়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আর এ দীর্ঘ যাত্রায় সব সময় জনগণের সঙ্গে থেকেছে দেশের ছাত্র-জনতা, যার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। আজ বিভিন্ন কারণে বা অজুহাতে অনেকে আন্দোলনের কথা বলেন বা চেষ্টা করেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আওয়ামী লীগবিহীন এ দেশে ১৯৪৭-পরবর্তী কোনো আন্দোলন সফল হয়েছে এমন নজির নেই। সম্প্রতি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনপূর্ব বিরোধী দলের নির্বাচন বানচালের চেষ্টা তারই অন্যতম উদাহরণ।
সব ভাষাশহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক