সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৫৯ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৫৯ পিএম
অলংকরণ প্রবা
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না। থাকলে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হতো না। এ আন্দোলন অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে, স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত এর গতিধারা প্রসারিত। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতা এ দেশের পুরোনো ব্যাধি, ইংরেজ আমলে এ ব্যাধির প্রকোপে আমরা অনেক দুর্ভোগ ভোগ করেছি। পাশাপাশি থেকেও দুই সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে শত্রুতা করেছে, নিজেদের স্বার্থ এক করে দেখতে পায়নি। ইংরেজ যুগে সৃষ্ট অতিশয় সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যে মুসলিম জীবন ও লেখকের উপস্থিতির সামান্যতাটা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, মুসলমান মধ্যবিত্ত সত্যি সত্যি পিছিয়ে পড়েছিল এবং হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে পিছিয়ে পড়া মুসলমানের এমন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি যাতে সাহিত্যে মুসলিম জীবন অনায়াসে চিত্রিত হতে পারে। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ রদ করা সম্ভব হয়েছিল বটে, কিন্তু ১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। বিভাগ মুসলমান মধ্যবিত্ত তো চেয়েছিল বটেই, শেষ পর্যন্ত হিন্দু মধ্যবিত্তের পক্ষেও না চেয়ে উপায় থাকেনি। ১৯০৫-এ যারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিল ১৯৪৭-এ তারা আর বিরোধী থাকতে পারেনি। এ রকমের একটা সাম্প্রদায়িক পরিবেশে, সাম্প্রদায়িকতার ফলে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রে এত তাড়াতাড়ি যে অসাম্প্রদায়িক গণআন্দোলন গড়ে উঠতে পারল, এর দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে পাকিস্তানের ব্যর্থতা ধরা পড়ে গিয়েছিল এবং সে ব্যর্থতা দেখে বাংলাদেশের মানুষ ভয় পেয়েছিল।
শুধু অসাম্প্রদায়িক নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও বটে। সমাজতন্ত্রের কথা আন্দোলনের কালে স্পষ্ট করে বলা হয়নি বটে, কিন্তু সন্দেহ নেই এ আন্দোলন ছিল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একটি সম্পূর্ণ নতুন ও অতিশয় প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা সরবরাহ করেছে তরুণ ছাত্রদের জীবনে। সে অভিজ্ঞতা আত্মত্যাগের ও নির্যাতনভোগের। বাংলাদেশের মুসলমানরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট দুর্ভোগ সহ্য করেনি, পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত দেয়নি বলে তরুণ সমাজের মনে একটা লজ্জা ছিল। ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি যখন রক্ত বইল, যখন কারাভোগ এলো, এলো পুলিশের পিছু নেওয়া তখন লজ্জা ঘুচল কিছুটা, দ্বিধা কাটল অনেক পরিমাণে, দৃঢ়চিত্ততা এলো সঙ্গে সঙ্গে।
এ দেশের লেখক, সাংবাদিক, গায়ক, চিত্রকর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্যে শিল্পের যে পরিমাণ উপাদান যত সহজে পেয়েছেন তেমন অন্য কোথাও পাননি। একুশে ফেব্রুয়ারি কোনোদিন ম্লান হয়নি, ১৯৫২ সালের পর প্রতিটি বছর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। বাইরে রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আবেদন কমেনি, ক্রমে বেড়েছে। তার কারণ এ আন্দোলন শক্তি পেয়েছে পাকিস্তানের ব্যর্থতা থেকে, যে ব্যর্থতার বোঝা দিন দিন বাড়ছিল, শক্তি পেয়েছে জনসাধারণের অসন্তোষ থেকে, যে অসন্তোষও প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের পুঞ্জীভূত রূপ হচ্ছে এ আন্দোলন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের দাবিদার মুসলিম লীগকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে দিয়ে সাধারণ মানুষ জানিয়ে দিল যে মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানের হাতে তাদের স্বার্থ যে নিরাপদ নয় এ সত্য তাদের কাছে আর অস্পষ্ট নয়। পরে সত্য আরও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে, যত প্রত্যক্ষ হয়েছে তত বেড়েছে বিক্ষোভ। বিক্ষোভ সব সময় প্রকাশের পথ পায়নি, যখন পায়নি তখন তা আরও বেশি দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টির উপাদান জোগাতে পেরেছে আরও এ কারণে যে, এ আন্দোলন বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা অত্যন্ত বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলিম মধ্যবিত্তের দৃষ্টি অনেক সময় ছিল পশ্চিমমুখো, তাদের মনে অভিমান ছিল, তাদের মাতৃভাষা বাংলা কি না এ নিয়েও একসময় প্রশ্ন উঠেছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি বুদ্ধিজীবীদের দেশের সঙ্গে একাত্ম করে দিল। তারা দেশের মানুষের হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। এতদিন ধর্ম ছিল ঐক্যের বন্ধন, এখন সেখানে এলো ভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারির পর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী যখন দেশের কথা বলছেন, তখন অধিকাংশ সময় তারা আসলে বাংলাদেশের কথাই বলেছেন, পাকিস্তানের কথা নয়। দেশপ্রেম তাদের দেশদ্রোহী করেছে- এক অর্থে। শুধু যে ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে তা নয়, মানুষের মধ্যে ঐক্যের বোধ বেড়েছে, বেড়েছে সচেতনতা, বেড়েছে সুন্দরতর জীবনের প্রতি আকর্ষণ। বাইরে যা-ই বলুক, পাকিস্তানের শাসকরা একুশে ফেব্রুয়ারি শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিল, তাই গণহত্যা শুরু করেই তারা ছুটে গিয়েছিল শহীদ মিনারের দিকে, মিনার ভেঙে দিয়ে আক্রোশ মিটিয়েছিল।
পশ্চিমা শাসকবর্গ বাংলা ভাষার ব্যাপারে একগুঁয়েমির পরিচয় দিয়েছিল। এর পেছনে ভয় ছিল, স্বার্থ নষ্ট হওয়ার ভয়, কিন্তু পরে যখন তারা দেখেছে যে এ আন্দোলন কিছুতেই স্তব্ধ হওয়ার নয় তখন ১৯৫৬ সালে এবং পরে ১৯৬২ সালের সংবিধানে বাংলাকে তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু ততদিনে বাংলাদেশের মানুষ আরও অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে। পাকিস্তানে যে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এটা তাদের জানা হয়ে গেছে এবং জানা হয়ে গেছে বলে তত দিনে তারা শুধু ভাষার অধিকার না, পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দাবি করেছে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সচেতনতা ও বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ যত বৃদ্ধি পেয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে তত বেশি চেষ্টা হয়েছে তাদের প্রলুব্ধ করবার। বুদ্ধিজীবীদের পেছনে আর্থিক বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের জন্য সংগঠন-প্রতিষ্ঠান গড়া হয়েছে, পুরস্কার পারিতোষিকের সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। বাইরে থেকে মনে হয়েছে প্রলোভনের জালে অনেকেই ধরা দিচ্ছেন। ধরা দিয়েছেন কেউ কেউ কিন্তু এমনকি যারা ধরা দিয়েছেন তারা দেখা গেছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে পারছেন না। তার কারণ পাকিস্তানের কৃত্রিমতাটা তাদের কাছে ততদিনে ধরা পড়ে গেছে। পাকিস্তানের শাসকরা চিরকালই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে ছিল, সেই দূরত্ব যে ক্রমে বাড়ছে, বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে তা-ও লক্ষ না করে উপায় ছিল না। সরকার টাকা দিল, কিন্তু মন গেল না। তমঘা দিল, সেই তমঘা পরে কেউ কেউ পরিত্যাগ করলেন, করে বিব্রত করলেন সরকারকে। সরকার সাহিত্যের জন্য পুরস্কার দিল, কিন্তু সে পুরস্কার সরকারবিরোধীরা পাওয়া শুরু করলেন। এমনকি পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার ওপর প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপকারী রচনাও পুরস্কার নিয়ে গেল। সরকার টাকা দিল লেখক সংঘ গড়বার জন্য, কিন্তু বাংলাদেশে দেখা গেল লেখক সংঘ সরকারি নীতির সমর্থন তো করছেই না, পরন্তু প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে।
সরকার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও পশ্চিম পাকিস্তানের ইতিহাস যে অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত তা প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু ইতিহাস তো সরকারের কেনা গোলাম নয়, ইতিহাস ওই কৃত্রিম ছকে আবদ্ধ হতে রাজি হয়নি। চেষ্টা হয়েছে এটা প্রমাণ করার যে বাংলা ও উর্দু ভাষার মধ্যে সাধারণ ঐতিহ্য আছে, আছে নিকটবর্তিতা। কিন্তু এসব কথায়ও বাংলাদেশের মানুষ সাড়া দেয়নি। উর্দু যে বাংলার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এ কথা তারা কিছুতেই ভুলতে পারেনি। বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও সরকারি কাজের ভাষা হিসেবে প্রয়োগ করার দাবি বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তুলেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও দাবি উঠেছে উর্দুর পক্ষে। মাতৃভাষা জীবনের সর্বত্র প্রচলিত করার পক্ষে দুই পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা অনেক সময় একসঙ্গে কথা বলেছেন। তারা বলেছেন এ দাবি গভীর দেশপ্রেম থেকে উৎসারিত। তা উৎসারিত ঠিকই, কিন্তু সে দেশ এক দেশ নয়, দুই দেশ। উর্দু প্রচলনের দাবি বাংলার আন্দোলনকে সাহায্য করেছে। সরকার চেষ্টা করেছে ধর্মের কথা বলতে, পাকিস্তান না থাকলে ইসলাম থাকবে না, ইসলাম না থাকলে বেঁচে থেকে কী লাভ- এ ধরনের যুক্তির অবতারণা করতে, কিন্তু এ ধর্মীয় প্রতারণায়ও কোনো সুফল হয়নি। বরং ভাষিক-জাতীয়তা আরও সুসংহত হয়েছে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সমাজ-বিশ্লেষক