ড. আতিউর রহমান
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৪২ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৪৭ এএম
অলঙ্করণ প্রবা
ভাষা আন্দোলনই সব শ্রেণির বাঙালিকে তাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাপূরণের সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রধান সহায়কের ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছিল। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণি পূর্ব বাংলার ওপর যে আঞ্চলিক নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছিল তারই প্রতিফলন ঘটে বাঙালির নানা আন্দোলনে। কখনও সংবিধান, কখনও অর্থনীতি, কখনও ভাষাসংক্রান্ত নীতির বিরুদ্ধে এসব আন্দোলনে তাদের তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশিত হতে থাকে। এ সবই ছিল আঞ্চলিক নিপীড়নের শিকার বাঙালির সামষ্টিক ক্ষোভের প্রতিফলন। তা ছিল পেছনের বিষয়। সামনে ছিল ভাষাপ্রশ্ন। তাই এ বিদ্রোহ ছিল অনিবার্য।
পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির ভাঁওতাবাজির প্রধান শিকার কৃষক-শ্রমিকই তৈরি করেছিল ভাষা আন্দোলনের নির্মাণ-রসদ। বিকাশমান মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ওই আন্দোলন দ্রুতই জাতীয় রূপ নেয়। এতে অংশগ্রহণকারীর প্রায় সবাই এসেছিল বঙ্গবন্ধুর মতো শ্রেণি অবস্থান থেকে। তাদের চাওয়াপাওয়াও ছিল প্রায় একই রকম। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর পরিচালিত আমাদের এক জরিপে জানা যায়, তিন-চতুর্থাংশই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী রাজনীতিসম্পৃক্ত ছিল। ভাবাবেগে ৬৭% সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। ২৫% উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। ৭৩% ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিল। ৪% মুসলিম লীগ সম্পর্কে ইতিবাচক। যদিও সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত ছিল। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে ব্যক্তিগত ক্ষতির চেয়ে জাতীয় বিকাশ ব্যাহত হবে বলে বেশিরভাগ উত্তরদাতাই মনে করত।
অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষার নানা সংকটের মধ্যে তাই ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছিল। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের শ্রেণি থেকেই বেরিয়ে এসেছিল ঊনসত্তর এবং একাত্তরের জাতীয়তাবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব। ১৯৪৮-৫২ পর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে শুভসূচনা হয় তারই সফল উত্তরণ ঘটে একাত্তরে। ঔপনিবেশিক ও তার সহযোগী শ্রেণির বিরুদ্ধে অধস্তন শ্রেণির (তথা পেটিবুর্জোয়া, ধনী ও মাঝারি ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, কৃষক) এক অভূতপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল বলেই এ উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল। তাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ভাষা আন্দোলন অধস্তন শ্রেণিসমূহের মিলিত চৈতন্যের ফসল।
ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথাও প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেন। এ সময়টায় তাঁর নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে সারা পূর্ব বাংলা সফর ও জনসভা করেন। তাঁর বক্তৃতায় গরিব চাষিদের ভাগ্যোন্নয়ন ছাড়াও পাট ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষানীতির ব্যাপক সমালোচনা করেন। জনগণের দুঃখ-বঞ্চনার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে বলে তিনি বারবার দাবি করেন। তিনি তাঁর ভাষণে প্রশাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ার কথা বলেন। করকাঠামোয় গরিবের স্বার্থ যে বিঘ্নিত হচ্ছিল সে কথাও তুলে ধরেন। খাদ্য সংকটে সরকারের উদাসীনতারও তীব্র সমালোচনা করেন। আর বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের কথা তো সর্বক্ষণই বলতেন।
এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে গণমানুষের পছন্দের নেতায় পরিণত হন। বাঙালির মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। এর পরপরই আসে চুয়ান্নর প্রাদেশিক নির্বাচন। ওই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং তার ইশতেহার একুশ দফা প্রণয়নেও শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ওই একুশ দফায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ছাড়াও পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির উপায়ের নানা কর্মসূচির কথা বলা হয়। এসব দাবির মূলেই ছিল পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মাঝে বিরাজমান বৈষম্য কী করে দূর করা যায়। এসব দাবি জনমনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যার ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ বিপুল ভোটে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করে।
চুয়ান্নর নির্বাচনে বিজয়ের পর মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য শেখ মুজিব কৃষি ও সমবায় মন্ত্রী হয়েছিলেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি এ অঞ্চলের শ্রমিক-কৃষক তথা সাধারণ মানুষের কল্যাণে সমবায়ের বিকাশসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে এ সরকার বেশিদিন টিকতে পারেনি। সরকারের পতনের পরপরই তাঁকে আটক করা হয়। এরপর জেল থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবিধানিক পরিষদের সদস্য হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদাসহ গরিবদুখী মানুষের পক্ষে সর্বক্ষণ সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৬ সালে আবার তিনি আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় শিল্প, বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময়টায় তিনি পূর্ব বাংলায় শিল্প ও ব্যবসায় কেন উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠতে পারেনি সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র পূর্ব বাংলাকে তাদের ‘কলোনি’ হিসেবে ব্যবহার করত বলে এখানে খুব বেশি শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। যাও-বা গড়ে উঠেছে তার মালিকানাও ছিল অবাঙালি উদ্যোক্তাদের হাতে।
কাঁচামাল আমদানির লাইসেন্স দিত রাজধানী করাচি থেকে। দুই অঞ্চলের মাঝে শ্রম ও পুঁজির সহজ লেনদেন সম্ভব ছিল না। পাটের রপ্তানি থেকে আয় করা বিদেশি মুদ্রা খরচ হতো পশ্চিম পাকিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়নে। পূর্ব বাংলায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো খুবই সামান্য। এ পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য বাঙালি উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশের পক্ষে বেশ কিছু সহায়ক নীতি গ্রহণ করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে পূর্ব বাংলার শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নয়নে বাড়তি অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন। সব মিলে ‘দুই অর্থনীতি’র স্বরূপ বোঝা তার জন্য কঠিন ছিল না। আর সে কারণেই দুই অঞ্চলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের কথা বলতে তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার। আর তাই সামরিক শাসন জারি করার পর সবার আগে তাঁকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
দুই বছরের বেশি সময় দুর্বিষহ জেলজীবন পাড়ি দিয়ে তিনি ফের দুই অর্থনীতির বিপদ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। তদ্দিনে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে তাঁর মতো করে ঢেলে সাজান। আর বৈষম্যের অর্থনীতির অবসানকল্পে ছয় দফা ঘোষণা করেন। এ ছয় দফা ছিল বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তিসনদ। এর মধ্যে তাঁর দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনার গভীর প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। তাঁর দুই অর্থনীতির ভাবনা থেকে ছয় দফায় উত্তরণ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে আমাদের ইতিহাসে। এ ছয় দফার পক্ষে জনরায় নিতেই তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশ নেন এবং বিপুলভাবে বিজয়ী হন। এ বিজয় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি। আর তাই তিনি বাঙালির মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
১৯৭২ সালে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধি’র অভিযাত্রার সূচনা করেন। মাত্র নয় মাসে জাতিকে উপহার দেন অধিকারভিত্তিক উন্নয়নের জন্য একটি চমৎকার সংবিধান। চালু করেন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। আর ধ্বংসস্তূপ থেকে সমৃদ্ধির অভিযাত্রায় পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এগোতে থাকেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে এই ‘দীঘল পুরুষ’কে বিশ্বাসঘাতকের দল হত্যা করে। সাময়িকভাবে হলেও থমকে দাঁড়ায় ভাষা আন্দোলনের পাটাতনে দাঁড়ানো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক