সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৮ এএম
আবারও সেই মর্মস্পর্শী খবর। লিবিয়া থেকে নৌকায় চড়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে
ভূমধ্যসাগরের তিউনিশিয়া উপকূলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সলিলসমাধি। মানব পাচারকারীদের ফাঁদে পড়ে ভাগ্যান্বেষীদের স্বপ্নের প্রায়
ক্রমাগত অপমৃত্যু সংগতই প্রশ্ন দাঁড় করায়, সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলো
কী করছে? ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘তিউনিশিয়া উপকূলে মৃতদের বেশিরভাগ বাংলাদেশি’
শিরোনামযুক্ত খবরের গর্ভে নিহিত সব বার্তাই মর্মস্পর্শী ছায়ার ওপর ফের মর্মস্পর্শী
ছায়া ছড়ায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া উপকূল থেকে ৫২ জনের একদল অভিবাসীর
সাগরপথে ইউরোপযাত্রাকালে তিউনিশিয়া উপকূলে তাদের বহনকারী নৌকায় আগুন লাগে। তিউনিশিয়ার
নৌবাহিনী ওই নৌকা থেকে ৯ জন অভিবাসীর মৃতদেহ এবং ৪৩ জনকে জীবন্মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।
ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে বিভিন্ন
দেশের উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টাকালে গত বছর তিন হাজারেরও
বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রাণ হারিয়েছেন কিংবা নিখোঁজ হয়েছেন, যাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক
এই অঞ্চলের। আমরা জানি, সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অবৈধ অভিবাসনের ব্যাপারে কঠোর
অবস্থান নিয়েছে এবং লিবিয়া-তিউনিশিয়ার নৌবাহিনীও এক্ষেত্রে নজরদারি কঠোর করেছে। এই
প্রেক্ষাপটে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপযাত্রা আরও বেশি বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে
উঠেছে। সরকারের তরফে ভাগ্যান্বেষণের লক্ষ্যে এভাবে কেউ যাতে অভিবাসনে আগ্রহী না হন,
তা বিভিন্ন মাধ্যমে বারবার সতর্ক করা হলেও আমরা দেখছি স্বপ্নপূরণের প্রত্যাশায় মৃত্যুযাত্রা
কোনোভাবেই থামছে না। সংগতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, এর প্রেক্ষাপট কিংবা কারণ কী? দেশের আর্থসামাজিক
ক্ষেত্রে বিদ্যমান সংকট, সমাজে ক্রমাগত বৈষম্য বেড়ে চলা, চাহিদার নিরিখে কর্মক্ষেত্র
প্রসারিত না হওয়া কিংবা বেকারের ক্রমবর্ধমান হার এই পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ী-বিদ্যমান
বাস্তবতায় সর্বাংশে তা মেনে নেওয়ার অবকাশ নেই। মানব পাচারকারীদের হাতে জীবন ও অর্থ
সঁপে দিয়ে ভাগ্যান্বেষণের এই চেষ্টা কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। যে অর্থ দালালের
হাতে তুলে দিয়ে জীবনের চাকা ঘোরাতে যৌবনের এই প্রয়াস তার চেয়ে অনেক কম অর্থ বিনিয়োগ
করে দেশেই আত্মকর্মসংস্থানমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে জীবনচিত্র বদলানো সম্ভব। এমন অনেক
নজির আমাদের সামনে আছে। তবে এই বাস্তবতা এড়ানো দুরূহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল
মহলগুলোর উদাসীনতা-ব্যর্থতার সুযোগে মানব পাচারের হোতারা অন্যের জীবন বলি দিয়ে নিজেরা
মোটাতাজা হচ্ছে।
দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে যারা সহায়সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে
ফের দালালদের হাতেই জিম্মি হন, এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি জানা সত্ত্বেও স্বেচ্ছায় কেন সম্ভাবনাময়
যুবকরা অপমৃত্যুর পথে পা বাড়াচ্ছেন, তা ফিরে ফিরে জিজ্ঞাসার বিষয় হয়ে দাঁড়ালেও যাদের
এ ব্যাপারে প্রতিকার-প্রতিবিধানের দায়দায়িত্ব রয়েছে তাদের নির্বিকারত্ব আমাদের উদ্বিগ্ন
যুগপৎ ক্ষুব্ধ না করে পারে না। ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে যারা শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট
গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছান তাদেরও সেখানে আরেক দালাল চক্রের মুঠোবন্দি হয়ে অমানুষিক নির্যাতন-নিপীড়নের
মুখোমুখি হতে হয় এবং মুক্তিপণ আদায়ের জন্য বহুমুখী চাপ সৃষ্টি হয় এমন বার্তাও ইতোমধ্যে
সংবাদমাধ্যমে কম উঠে আসেনি। ভুক্তভোগী পরিবারের অনেকেই ইতঃপূর্বে বলেছেন, তাদের কাছে
অপরিচিতি মুঠোফোনের নম্বর থেকে ফোন এসেছে এবং লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয় অতিসংক্ষিপ্ত
সময়ের কথোপকথনে। কেউ কেউ হয়তো বিভিন্নভাবে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেলেও অনেকের আর কোনো
হদিসই মেলেনি এমন বার্তাও সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে। আমরা জানি, কেবল লিবিয়া হয়ে ইউরোপ
গমন-ইচ্ছুকরাই প্রতারণা-জালিয়াতির শিকার হচ্ছেন না, আরও বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের
লোভের ফাঁদে ফেলছে মানব পাচার চক্রের হোতারা। মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার নামে দালাল চক্র
অনেককেই সমুদ্রপথে যাওয়ার নাম করে ট্রলারে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নামিয়ে লাখ লাখ টাকা
হাতিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার নজিরও আছে। কখনও কখনও মানব পাচার চক্রের চুনোপুঁটিদের আটক
করা হলেও তাদের শিরোমণিদের কেশাগ্র স্পর্শ তো দূরের কথা, কোনো সন্ধানই করা যায়নি! আমাদের
এ-ও অজানা নয়, মরুপথে কিংবা মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী পাহাড়-জঙ্গলেও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের
ফেলে পালিয়ে গেছে দালালরা। থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের গণকবরের সন্ধান
মেলার মর্মন্তুদ ঘটনাও দূর অতীতের নয়। তা ছাড়া লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে বহু
বাংলাদেশি অবৈধভাবে পাড়ি দিয়ে চরম বিপদে আছেন এবং বিভিন্ন দেশে আটকা এসব বাংলাদেশিকে
উদ্ধারও করা হয়েছে, তা-ও অনেকেরই জানা।
আমরা মনে করি, বিপন্নদের উদ্ধার করাই যথেষ্ট নয়- জরুরি হচ্ছে পাচারকারীদের
সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আমাদের স্মরণে
আছে, একজন সংসদ সদস্য মানব পাচারের দায়ে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে দণ্ডিত হয়ে কারাভোগ
করছেন। তা ছাড়া অতীতে জীবন নিয়ে জুয়া খেলার দায়ে কোনো কোনো জুয়াড়ি রাজনীতিক কিংবা জনপ্রতিনিধির
পরিচয়ও মিলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো এর পরিপ্রেক্ষিতে
কাজের কাজ কতটা কী করতে পেরেছে? ইউরোপ এবং অন্য দেশে ভাগ্যান্বেষণের মরণফাঁদ বন্ধ
করতে না পারার দায় সরকার এড়াতে পারে না। বাংলাদেশের সঙ্গে এমন অভিবাসনপ্রত্যাশীদের
তালিকায় সিরিয়া, আফগানিস্তান, সুদান কিংবা ইরিত্রিয়ার মতো আরও কিছু দেশের নাম এক কাতারে
থাকলেও বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা তাদের মতো নয়। দেশ এখন উন্নয়ন-অগ্রগতির মহাসড়কে ধাবমান।
এই প্রেক্ষাপটে মানব পাচারের মতো কদাচার-দুরাচারের পথ রুদ্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কোনো
অবকাশই নেই।
আমরা মনে করি, মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ পুষ্ট করার ব্যাপক কার্যক্রমের
পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সুড়ঙ্গের একেবারে
শেষ প্রান্তে দিতে হবে দৃষ্টি। সুড়ঙ্গমুখে কিংবা এর উপরিভাগের প্রলেপ সরানোর মতো ‘টোটকা
দাওয়াই’য়ে গুরুতর ব্যাধির উপশম দুরূহ। বাংলাদেশ অবৈধ অভিবাসনে কোনোভাবেই সমর্থন দেয়
না। মানব পাচারের মতো গুরুতর ব্যাধির কারণে আমাদের ভাবমূর্তি তো নষ্ট হচ্ছেই একই সঙ্গে
সমাজ-পরিবারে নেমে আসছে গাঢ় ছায়া। আমরা মনে করি, সময়ক্ষেপণ না করে যথোপযুক্ত প্রতিবিধান
নিশ্চিত করতেই হবে। গেটকিপারদের শক্তিশালী করা গেলে ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনপ্রক্রিয়ার পথ
রুদ্ধ করা দুরূহ নয়। দায়িত্বশীল সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি নজর দিতে হবে
উৎসে।