× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ

সীমান্ত নিরাপত্তা ও বহুমুখী ভূরাজনৈতিক সংকট

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৭ এএম

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ আরও জটিল এবং ভিন্ন মোড় নিয়েছে। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো লড়াই চালাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা চরম সংঘাতপূর্ণ। ফলে নিরাপত্তা সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ভারতসহ মিয়ানমারের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও। ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ সহযোগী সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু মিয়ানমারকে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। মিয়ানমারে সৃষ্ট পরিস্থিতি দেশটির পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করতে পারে, এ অভিমত ব্যক্ত করে তিনি এ সতর্কবার্তা দিয়েছেন।

মিয়ানমারের গৃহদাহ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু অগ্নিগর্ভ মিয়ানমারের তাপ এসে পৌঁছুচ্ছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা আর মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে থাকছে না। আমরা জানি, মিয়ানমার সেনাদের সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকায়। সীমান্ত পেরিয়ে আসা গোলাগুলিতে জানুয়ারি মাসে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন বাংলাদেশের সীমান্তে। ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি মর্টার শেল বিস্ফোরণে দুজন নিহত হন। ওই ঘটনার পর মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সীমান্তে নিরাপত্তা সংকটের পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট নতুন মোড় নিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ভিড় জমাচ্ছে মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের নতুন ঢল আশ্রয়দানকারী দেশ বাংলাদেশের জন্য নতুন সংকট সৃষ্টি করবে কি না- এ প্রশ্নও নানা মহলে ইতোমধ্যে উত্থাপিত হয়েছে। মিয়ানমারে গৃহদাহের ধারাবাহিকতা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তা বাংলাদেশের জন্য সার্বিকভাবে ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। মিয়ানমারের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার সজাগ ও সতর্ক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সীমান্তের ওপারে চলমান তীব্র সংঘাতের কারণে সীমান্ত নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষায় সদা জাগ্রত। মিয়ানমারে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তাতে সীমান্তে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকতে পারে। কাজেই এই বিষয়ে আমরা প্রস্তুত আছি।’ ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। তবে আমার বক্তব্য, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শুধু সীমান্তরক্ষাই নয়, নজর দিতে হবে আরও গভীরে।

মিয়ানমারের সঙ্গে লাওস, থাইল্যান্ড, চীন, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত রয়েছে। সংগত কারণেই মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘাত-সহিংসতা সীমান্তসংলগ্ন অন্য দেশকেও প্রভাবিত করবে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বড় অংশজুড়ে রয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা। আমাদের সীমান্তের অপর পাশেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। সম্প্রতি কয়েকজন অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করলে তাদের আটক করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর সদস্যরা। পরে তাদের আদালতে প্রেরণ করে রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ১২ রোহিঙ্গার মধ্যে অসুস্থ একজন ছাড়া অপর ১১ জনকে তিন দিনের রিমান্ডের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। সংবাদমাধমেই প্রকাশ, ১৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তিন দিনের রিমান্ড শেষে ১১ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যার আদালতে হাজির করা হলে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে চলমান সহিংস উত্তাপের কতটা আঁচ এসে পড়ছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে, তা অস্পষ্ট নয়। বিবদমান পক্ষগুলোর লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ছে আমাদের ভূখণ্ডে। সীমান্ত এলাকার জনজীবনে এর মারাত্মক অভিঘাত লেগেছে।

সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দা এমনকি টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গারাও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শত শত সদস্য অস্ত্রশস্ত্রসহ পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে। কিছুদিন আগে সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সংঘর্ষ শুরু হয়। বিদ্রোহীরা বিজিপির কয়েকটি ফাঁড়ি দখল করে নিলে ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে পালিয়ে বিজিপি সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে। কয়েক সেনা সদস্যও ছিলেন তাদের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত তাদের ফেরত পাঠানো গেছে। মিয়ানমারে গৃহদাহের সীমান্তবর্তী প্রভাব ক্রমেই যেন বহুমুখী হয়ে উঠছে। আমরা জানি, মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সামরিক বাহিনীর সামরিক রসদের সরবরাহ কমছে। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর মনোবলও বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে কমতে শুরু করেছে। তাদের একের পর এক বিজয়ও আমাদের সে বার্তাই দেয় ৷ মিয়ানমারের এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা খুব জরুরি যাতে বিদ্যমান সংকটের সমাধান করা যায়। যদি তা না করা যায়, তাহলে সংঘাত-সহিংস পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। মিয়ানমারে ক্ষমতাসীনরা সামরিক সমাধানের পথে হাঁটলে যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হবে। এই দীর্ঘতার সূত্র থেকে সংকটে কোনো পক্ষ বিজয়ী হলেও বিদ্যমান অস্থিরতা দ্রুত মেটানো সম্ভব হবে না৷

মিয়ানমারে জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে যত এলাকা বিদ্রোহীদের হাতে চলে যাচ্ছে তাতে তারা ততই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাই মিয়ানমারে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিরসনে রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ে বিশ্বনেতাদের আশু ভাবনাও জরুরি। মিয়ানমারে গৃহদাহ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বটে, কিন্তু মিয়ানমার পরিস্থিতি দেশটির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিরাপত্তাজনিত সংকট সৃষ্টি করতে পারে, যা আর অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে থাকে না। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে তাদের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নানা জটিলতা তৈরি করবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংকট আরেকটু জটিল। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গারা এখানে আশ্রিত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়েও আমাদের ভাবতে হচ্ছে। আবার রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হচ্ছে। তবে মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশ বরাবরই নিরপেক্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। মিয়ানমারে যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশকে আরও কৌশলী কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।

আমরা জানি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে কূটনীতি চালাচ্ছে। তবে এখন তাতে নতুন মাত্রা যোগের বিষয়টি সামনে এসেছে। ভূরাজনৈতিক কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে চীন ও ভারতের সম্পর্ক ও স্বার্থ আছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তো বটেই, এই দুই দেশও অতটা সক্রিয় প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে যেহেতু এই দুই দেশের নিরাপত্তাও সংকটের মুখে পড়েছে, সেহেতু তারা এবার এ বিষয় নিয়ে ভাববে। নিরাপত্তা সংকট তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের মধ্যকার আঞ্চলিক জোট গঠিত হওয়ার সম্ভাবনার প্রত্যাশা করা হচ্ছে। যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে চীন ও ভারতের কাছে এতদিন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সক্রিয় যে ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল তা পূরণ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে নতুন পরিসরে আলোচনা করার সুযোগও বেড়েছে৷

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়েছে, এ ভাবনা অমূলক নয়। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে আরও সতর্ক হতে হবে৷ সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য যা কিছু করণীয় করতে হবে৷ বিশেষত সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর বিষয়টিকে বেশি জোর দিতে হবে৷ মিয়ানমারে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী জান্তা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে তাদের অস্ত্র ও সামরিক রসদ ছিনিয়ে নিচ্ছে৷ একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলের একটি অংশ তাদের সামরিক পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, এমন অভিযোগও রয়েছে। এমনটি হলে পাহাড় তো বটেই সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে। এমনটি আমাদের জন্য শুভকর কিছু হবে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ চীন-ভারতের সঙ্গে নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণের প্রক্রিয়া ভিন্ন আঙ্গিকে কূটনৈতিক চ্যানেলে শুরু করার প্রয়াস চালাতে পারে। কারণ, এখন যে পরিস্থিতি মিয়ানমারে বিরাজ করছে তা শুধু বাংলাদেশ নয়, সীমান্তবর্তী সব দেশের জন্যই নিরাপত্তা সংকট বাড়াতে পারে। মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ সহসা শেষ হওয়ার আলামত লক্ষ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রত্যেকটি দেশকে বিদ্যমান পরিস্থিতি নিজেদের স্বার্থেই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখে কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে এগারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বোঝা বহন করার পাশাপাশি ফের মিয়ানমারের চলমান সৃষ্ট পরিস্থিতিতে যে উদ্বেগজনক অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে তা এখন শুধু বাংলাদেশের একার জন্য নয় বরং মিয়ানমার সীমান্তবর্তী প্রত্যেকটি দেশকেই সেভাবে পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা বাঞ্ছনীয়। 

  • নিরাপত্তা-বিশ্লেষক ও নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা