স্মরণ
রাজু আহমেদ
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:১৫ পিএম
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার
উষালগ্নে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে আত্মদানকারী প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহাÑ
যাঁর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের দাবানল সারা দেশে বিদ্যুৎগতিতে
ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৬৯ সালের এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) প্রধান
ফটকের সামনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন অকুতোভয় ড. শামসুজ্জোহা।
১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার খবর আসে রাবিতে। পরের
দিন অর্থাৎ ১৭ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে শত শত শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে
রাজশাহী শহর অভিমুখে রওনা দিলে বোয়ালিয়া থানার পুলিশের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। মিছিলের
ওপর পুলিশের আক্রমণে আহত হন অনেকে। আহতদের আটক করে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। খবর
পেয়ে ড. জোহা কয়েকজন শিক্ষককে নিয়ে ছুটে যান থানায়। আহত ছাত্রদের চিকিৎসার জন্য পুলিশের
সঙ্গে বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত হন। নিজের প্রক্টর পরিচয় দিয়ে সেনাবাহিনীকে শিক্ষার্থীদের
ওপর গুলি না ছোড়ার নির্দেশ দেন। পরের দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি
করা হয়। রাবির সামনের সড়কে পুলিশ ও সেনা মোতায়েন করা হয়। জিন্না হলের সামনের রাস্তায়
১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দিচ্ছিল প্রশাসনের একটি জিপ। ছাত্ররা জিপে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ
হলে ঢুকে অভিযান চালাতে চাইলে প্রক্টর ড. জোহার মধ্যস্থতায় সেই উত্তেজনা প্রশমিত হয়।
১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে রাবি শিক্ষার্থীরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা
করে মিছিল নিয়ে শহরের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এসময় শত শত শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে
বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। মিছিল নিয়ে রাবির প্রধান ফটক অতিক্রম করে শহরের দিকে যাওয়ার
চেষ্টা করে তারা। বিষয়টি জানতে পেরে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিচলিত হয়ে
পড়েন ড. জোহা।
দ্রুত ছুটে যান ছাত্রদের শান্ত করতে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত
হয়ে তিনি সেনাসদস্য ও ম্যাজিস্ট্রেটকে সেখান থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু উলটো
তারা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর গুলি ছুড়তে থাকে। তিনি শিক্ষার্থীদের রাবির প্রধান
ফটকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে আসেন সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনকে বুঝিয়ে
শান্ত করতে। এ সময় বন্দুকের একটি গুলি এসে লাগে তার গায়ে। চিৎকার দিয়ে তিনি মাটিতে
লুটিয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে না নিয়ে তাকে রাজশাহী কলেজের সামনে অবস্থিত তৎকালীন
মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের বারান্দায় দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখা হয়। রক্তক্ষরণে ক্রমেই নিস্তেজ
হয়ে পড়েন তিনি। হাসপাতালে যখন তাকে অস্ত্রোপচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়, ততক্ষণে অনেক
দেরি হয়ে গেছে। যথাসময়ে হাসপাতালে না আনায় প্রাণ হারান তিনি।
ড. জোহা তার আত্মত্যাগের মাধ্যমে নিশ্চয় অভিধানে নতুন
শব্দের সংযোজন করেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের অহংকার, তরুণ প্রজন্মের কাছে দায়িত্ব
ও কর্তব্যবোধসম্পন্ন একজন শিক্ষক, একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। ড. জোহা যুগে যুগে শিক্ষকসমাজের
জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জোহা
দিবস হিসেবে পালন করে আসছে এবং দিবসটিকে শিক্ষক দিবস হিসেবে স্বীকৃতির দাবিও জানিয়ে
আসছে। শিক্ষার্থীদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ড. জোহা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেয়েছেন শিক্ষার্থীদের
নিরাপত্তা। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
· সাংবাদিক