× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আর্থিক খাত

সুশাসন ছাড়া ব্যধির উপশম হবে না

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:০৮ পিএম

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

ব্যাংক খাতকে অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড কিংবা রক্ত সঞ্চালনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিহিত করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেন, হৃদয় ভালো থাকে রক্ত সঞ্চালনের কারণে। আমাদের ব্যাংক খাতে অর্থাৎ অর্থনীতির হৃৎপিণ্ডে যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব নানাবিধ সংকট তৈরি করছে। দেশের ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা নিয়ে ইতোমধ্যে কথা কম হয়নি। সুশাসন ছাড়া এ খাতে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম বন্ধ সম্ভব হবে না, এ কথা ইতঃপূর্বে বহুবার বলেছি। সুশাসনের অভাব থাকায় ব্যাংক খাতে নানা ক্ষেত্রে গ্রাহককে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। সুশাসন নেই মানে জবাবদিহি এবং এর ধারাবাহিকতা একেবারেই নেই। ফলে এ খাত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকেই দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে উঠছেন, এ অভিমতও অনেকের। সম্প্রতি রূপালী ব্যাংকের গ্রাহকের লাখ লাখ টাকা নয়ছয়ের চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। গোপালগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে অনেক গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকটির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব থাকায় ব্যাংকের পরিচালক কিংবা সংশ্লিষ্ট অনেকেই নানা সুযোগে নয়ছয় করেন। ব্যাংক পরিচালনার নীতিমালা তারা যথাযথভাবে অনুসরণ করেন না, এমন অভিযোগও রয়েছে। এ খাতে শৃঙ্খলার অভাবের চিত্র সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের ব্যাংকেই বিদ্যমান। জবাবদিহি না থাকায় নিয়োগপ্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ব্যাংকিং কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা থাকে না। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যারা আছেন তারা যেন নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করেন না। ব্যাংক শেষ পর্যন্ত যেন তাদের নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠেছে। এমনটি দুঃখজনক। গ্রাহকের কাছে ব্যাংক নিরাপদ লেনদেন এবং সঞ্চয়ের প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক আমানতকারীর ভূমিকা পালন করে। সঞ্চয়ের নিরাপদ এ প্রতিষ্ঠানই যখন আমানতের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তখন গ্রাহকের আস্থা হারান। ব্যাংক তার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঞ্চয় কিংবা আমানতের ওপরও নির্ভর করে। যদি গ্রাহক না থাকেন তাহলে ব্যাংকে তারল্যসংকট বাড়বে। এবং সুষ্ঠু কার্যক্রম ব্যাহত হবে। সার্বিকভাবে অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আমরা দেখছি, আর্থিক খাতে বিভিন্ন সময় অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর সমালোচনাও হয়। কিন্তু তাদের আইনের আওতায় এনে প্রতিবিধান নিশ্চিত করা হয় না অনেক ক্ষেত্রেই। অভিযোগ আছে, ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব খাটিয়ে অনেকে ঋণ নেন। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক চাপে সৎ এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না, এ অভিযোগও পুরনো। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে না পারায় ব্যাংক খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পুঁজির পরিমাণ, তফসিলিকরণ, সিঙ্গেল এক্সপোজার লিমিট, ঋণের শ্রেণিকরণ, সাব স্ট্যান্ডার্ড, মন্দ ঋণ, খেলাপি ঋণসহ নানা সমস্যার সমাধান বা চ্যালেঞ্জ ব্যাংক খাত সামাল দিতে পারছে না সুশাসনের অভাবে।

খেলাপি ঋণ আমাদের অর্থনীতির অন্যতম বিষফোড়া। খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে অনেক উদ্যোগের কথাই আমরা শুনেছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর কোনো সুফল দৃশ্যমান হয়নি। সম্প্রতি ১৭টি ‘অ্যাকশন প্ল্যান’-এর কথা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ১৭টি কর্মপরিকল্পনার মধ্যে ১১টি খেলাপি ঋণ ও অবলোপন ঋণ সংক্রান্ত। বাকি ৬টি জোর দিয়েছে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ, অন্তত পরিকল্পনার দৃষ্টিতে। কিন্তু জোর দিতে হবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায়। খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাঞ্ছনীয়। খেলাপি ঋণ হয় বিভিন্ন দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব থাকলে। সমস্যা হলো, খেলাপি ঋণ থাকলে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ ব্যাংকগুলোর সদিচ্ছা থাকলেও ঋণখেলাপির কারণে সুশাসন নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তাই নয়, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল সিদ্ধান্তগুলো সংশোধনের বিষয়েও ভাবতে হবে।

ধারাবাহিক চতুর্থবারসহ পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার কঠোর নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও বাজারে তুঘলকি কাণ্ড চলছেই। সম্প্রতি পেঁয়াজ নিয়ে আরেক দফা তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম। নতুন পেঁয়াজ ওঠার আগে অন্তর্বর্তী সময়ে সরকার বিদেশ থেকে বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে থাকে। কিন্তু এবার ডলার সংকটসহ পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার কারণে আমদানি করা যায়নি। অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করার যথাযথ উদ্যোগ সময়মতো না নেওয়ার বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অদূরদর্শিতা অবশ্যই। কারণ অভ্যন্তরণী বাজারে সুযোগ পেলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা অপতৎপরতা চালান। খণ্ডিত উদাহরণ হলোÑচাল নিয়ে চালবাজি চলছেই।

১৬ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯.৮৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগের দুই মাস মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও ফের বেড়েছে জানুয়ারিতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হালনাগাদ ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্য ও মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও বেড়েছে খাদ্যবর্হিভূত মূল্যস্ফীতি। সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী বিভিন্ন আড়তে মজুদবিরোধী অভিযান চালিয়ে মজুদদারদের আর্থিক জরিমানা করা সত্ত্বেও এ অপকাণ্ড থেমে থাকেনি। অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে চালের দামও। বাজারে সুশাসনের ঘাটতির মাশুলই ভোক্তাকে দিতে হচ্ছে। বাজারে সুশাসনের পেছনে নজরদারি-পরিবীক্ষণের অভাব অনেকাংশে দায়ী। আমরা দেখছি, যখনই বাজারে সিন্ডিকেটের উপস্থিতির কথা জানা যায় তখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় লোকদেখানো কিছু পদক্ষেপ নেয়। অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কিন্তু সারা দেশের প্রেক্ষাপটে এমন অভিযান ধারাবাহিক এবং সবখানে সমগুরুত্ব পায় না। তাই বাজার অব্যবস্থাপনা টিকে থাকে।

আমরা দেখছি, উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের দামের ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক। অভিযোগ আছে, মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজিতে তাদের উদরপূর্তি হয় ভোক্তা ও উৎপাদককে যাতনায় ফেলে। এগুলো বাজারব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ত্রুটি। এ ত্রুটি সমাধান করতে হলে বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। উৎপাদক, বিক্রেতা ও ক্রেতার মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী এ চাঁদাবাজদের অপতৎপরতা রুখে দিতে পারলে বাজারে কিছুটা হলেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। চাঁদাবাজরা বাজারে জোগান ও মজুদের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাদের সঙ্গে অতিমুনাফালোভী ও অসাধু ব্যবসায়ীরা আঁতাত করেন। এভাবেই বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। দেশে খাদ্যপণ্যের অভাব যে রয়েছে তা কিন্তু নয়। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কিছু কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। তখন আমরা আমদানি করি। প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য অসাধু ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করে রাখে এবং বাজারের সরবরাহ বিঘ্নিত করে নানা সুযোগ নেয়। এ ক্ষেত্রে বাজারে নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই। বিশেষত অতিমুনাফালোভী কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীরা ধরা পড়লে নগণ্য শাস্তি পেয়ে থাকেন। নগণ্য শাস্তি পান বলে তারা আইনের তোয়াক্কা করেন না। বাজারব্যবস্থা সম্পূর্ণ ত্রুটিপূর্ণ। বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তনের পাশাপাশি বড় বড় সমবায় বা বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। যখন দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হবে তখন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সহজ হবে। বিশেষত মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যও অনেকাংশে কমবে।

সরকার আশা করছে শর্ত যথাযথ পূরণ করা এখন পর্যন্ত সম্ভব না হলেও আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে। দেশের বাস্তবতায় ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করে দেওয়ার বাস্তবতা আছে। কিন্তু এ দেশের বাস্তবতা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক বোঝে না এমন মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের যেকোনো শর্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজস্ব কাঠামো ও নীতিমালার ওপর নির্ভর করতে হয়। তারা এ কাঠামোর বাইরে গিয়ে শর্ত দেয় না। যেহেতু একেকটি দেশের ভৌগোলিক বাস্তবতা আলাদা তাই কিছু কিছু শর্তের ক্ষেত্রে এমনটি মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে আইএমএফের প্রস্তাবিত কিছু শর্ত বাস্তবায়ন করা যেতে পারে যা আমাদের জন্য ইতিবাচক ফলই এনে দেবে।

১৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশ, রিজার্ভ বাড়াতে নতুন কৌশল নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই প্রতিবেদনেই আরও বলা হয়েছে, রিজার্ভ পতনের নেপথ্যে রয়েছে আর্থিক হিসেবের ঘাটতি। আমরা দেখছি, নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েও রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগেও বলেছি এবং আবারও বলি, অবস্থার উন্নতি করতে হলে টেকসই নীতি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সামষ্টিক অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদী হুমকিতে যাতে না পরে এ ব্যাপারে মনোযোগ গভীর করার পাশাপাশি নতুন কর্মকৌশলও অত্যন্ত জরুরি। সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এর অন্যতম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা। এ দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে এগোতে হবে। তবে  এও মনে রাখা দরকার, শুধু কর্মপরিকল্পনা নিলেই হবে না, এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।

  • অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা