× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

নতুন শিক্ষাক্রম

বৈষম্য ও সংকটের প্রেক্ষাপটে আটটি প্রশ্ন

আনু মুহাম্মদ

প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০০:৩৬ এএম

আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:২২ পিএম

আনু মুহাম্মদ

আনু মুহাম্মদ

সম্প্রতি সরকারের গৃহীত শিক্ষাক্রম নানা ধরনের সমালোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কিন্তু শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং এমনকি শিক্ষকদেরও প্রশ্ন মোকাবিলা না করে তার বিপরীতে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলেই দেখা যাচ্ছে। বিশেষত বেশ কিছু প্রতিবাদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের গ্রেপ্তারের খবরও সংবাদমাধ্যমে পাওয়া গেছে। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ আয়োজিত আলোচনা সভা বন্ধ করার ঘটনা অভাবনীয়। শিক্ষাক্রমে পরিমার্জন প্রসঙ্গে সরকার শিক্ষক, অভিভাবক এমনকি শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের বিষয়ে সরকারের মারমুখী অবস্থান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

সরকারের দাবি অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের কোচিং, গাইড, পরীক্ষা এবং মুখস্তনির্ভরতা থেকে বের করে আনার জন্য নতুন এই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করে- এ অভিযোগ বহু পুরোনো। শিক্ষার্থীদের একগাদা বই মুখস্ত করতে হয় এবং প্রচন্ড চাপের মুখে পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষার চাপ ডিঙোনোর জন্যই গাইডবই ও কোচিং সেন্টার নির্ভরতা বাড়তে থাকে। আমরা সবসময়ই চেয়েছি, শিক্ষার্থীরা শেখার আনন্দ থেকে যেন বঞ্চিত না হয় তেমন শিক্ষাকাঠামো গড়ে তোলা হোক। কিন্তু বছরের পর বছর শিক্ষার্থীরা ধকলমুক্ত হতে পারেনি। সরকার শিক্ষার্থীদের ধকলমুক্ত করার কথা বলছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রের অবকাঠামো, শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির বিদ্যমান বাস্তবতায় সংগত কারণেই প্রশ্ন জাগে, অতীতের সংকট নিরসন করতে গিয়ে সরকার শিক্ষার্থীদের আরও বড় জটিলতায় ফেলে দিচ্ছে কি-না।  

পুরোনো শিক্ষাক্রমের সংকট ও নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সরকার যা বলেছে তা খুবই ঠিক। ওই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের কোচিং ও গাইডের ওপর নির্ভরশীলতা একটা ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এমন ব্যবস্থা কারা তৈরি করেছিল? বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় আছে। পুরোনো শিক্ষাক্রমও তারাই প্রণয়ন করেছিল। তখনও সরকার ‘সৃজনশীল শিক্ষাক্রম’-এর দাবি করেছিল। দাবি করা হয়েছিল নতুন ওই শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাইডবই ও কোচিং নির্ভরতা হ্রাস পাবে। বলাই বাহুল্য, ফলাফল উল্টো হয়েছে। সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরকে অষ্টম শ্রেণী এবং মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত উত্তীর্ণ করার কথা বলা হয়েছিল, সেটাও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং শিক্ষানীতিতে না থাকলেও অজানা কারণে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেনীতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হয়েছিল। পাবলিক পরীক্ষা বেড়ে যাওয়ায় কোচিং ও গাইডবই নির্ভরতা বেড়ে গেছে। অতীত ব্যবস্থার যথাযথ পর্যালোচনা ও দায়দায়িত্ব নির্দিষ্ট না করে, ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান এবং তার স্বীকৃতির সাথে বাস্তব সমস্যা বিবেচনা না করে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরকম সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া যে কাজের কাজ হয় না সেই উপলব্ধির অভাব সার্বিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে সংকটগ্রস্ত করছে। নতুন শিক্ষাক্রমের গ্রহনযোগ্যতার সাফাই হিসেবে জাপান ও ফিনল্যান্ডের উদাহরণ টানা হচ্ছে। জাপান ও ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চমান নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু তাদের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক দিকটাও তো দেখতে হবে। আমাদের সাথে তাদের পার্থক্যগুলো গুরুতর। এখানে শুধু সংক্ষেপে আটটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

প্রথমত, জাপান কিংবা ফিনল্যান্ডে আমাদের দেশের মতো শিক্ষাব্যবস্থায় এরকম বৈষম্য নেই, নানা মাধ্যম নেই, শিক্ষাব্যয়ের চাপ নেই, এতোরকম ধারা নেই। ওই দেশগুলোতে সকল শিক্ষার্থী একই ধারার ও মানের শিক্ষা গ্রহণ করে। আর বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা সম্পন্ন করে। আছে ক্যাডেট কলেজ। এগুলোর মধ্যে মানের অনেক তফাৎ হয়। এর বাইরে বেসরকারি স্কুল-কলেজে অনেক শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করে। এছাড়া আছে কওমি মাদরাসা, আলিয়া মাদরাসা, ইংরেজি মাধ্যম ক্যাডেট মাদরাসা। ইংরেজি শিক্ষামাধ্যমে লেখাপড়া ব্যয়বহুল, এগুলোর মধ্যে অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং কমব্যয়বহুল আছে। শিক্ষাক্রম ও মানের দিক থেকে এইসবগুলোর মধ্যে অনেক পার্থক্য।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে শিক্ষা বিষয়ক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা রয়েছেন তাদের সন্তানেরা মূলধারায় লেখাপড়া করে না, সেজন্য এর ফলাফল নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের সন্তানেরা হয় দেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করে অথবা চলে যায় বিদেশে। আর ঐসব দেশে নীতিনির্ধারকরা ঘনিষ্ঠভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত কেননা তাদের সন্তানেরা সেখানেই লেখাপড়া করে।

তৃতীয়ত, ফিনল্যান্ডে সবার জন্য একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছে, নাগরিকদের সকল পর্যায়ে বিনামুল্যে শিক্ষাসেবা দেয়া হয়। তাই শিক্ষাকে পুঁজি করে বাণিজ্য করার পথ সেখানে নেই। সেকারণে কোচিং স্টোর, গাইড বই ইত্যাদির উৎপাত তৈরির কোনো সুযোগ নাই সেখানে। আর সেসব দেশে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের বই থেকে শুরু করে শিক্ষার জন্য খরচ নিয়ে ভাবতেও হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য এত বেশি যে এটি ব্যয়ের ভীষণ বোঝা তৈরি করে।

চতুর্থত, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ। সফল শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করেছে এমন দেশগুলোতে শ্রেণীকক্ষে ২০ কিংবা ২৫ জন শিক্ষার্থীর তত্বাবধানে একজন শিক্ষক নিয়োজিত থাকেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনপ্রতি একজন শিক্ষককে ৫০, ৬০ এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ১০০ জন শিক্ষার্থীর তত্বাবধান করতে হয়। শুধু তাই নয়, আমাদের শিক্ষা অবকাঠামোর অবস্থাও করুণ। বিপুল অধিকাংশ স্কুল-কলেজে উপযুক্ত গবেষণাগার, পাঠাগার এবং যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষক নাই। অথচ অন্যদিকে অত্যাবশ্যক হলেও হাজার হাজার শিক্ষকের পদ খালি পড়ে থাকে।

পঞ্চমত,  ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা আকর্ষনীয় ও সম্মানজনক পেশা। নতুন প্রজন্মের কারিগর হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চ সম্মান দেয়া হয়। শিক্ষকদেরই সেখানে গুরুত্ব দেয়া হয় সবচাইতে বেশি। এর বিপরীতে বাংলাদেশে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সম্মানী নিশ্চিত তো করা হয়ই না উপরন্তু উপযুক্ত সম্মানপ্রাপ্তি থেকেও তারা বঞ্চিত। জীবিকানির্বাহের জন্য তাদের কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউশনির ওপর নির্ভর করতে হয়। সরকারি বিদ্যালয়েও শিক্ষকরা পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা পান না। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও করুণ। বছরের পর বছর ঢাকায় এসে অবস্থান, অনশন করেও এসব সমস্যার সমাধান হয় না। উল্টো তাদের ওপর পুলিশী হামলা দেখা যায়।

ষষ্ঠত, শিক্ষাখাতে বিদ্যমান বৈষম্য ও সংকটের প্রেক্ষাপটে এ প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ, এই খাত রাষ্ট্রের কাছে কেন এতটা অবহেলার শিকার? বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে ব্যয় বিশ্বে একেবারে নীচের সারিতে। ফিনল্যান্ড জাপান তো বটেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কাও জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় করে। অন্যদিকে আমাদের দেশে তা ২ শতাংশেরও কম। ফলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষকদের যথাযথ বেতনকাঠামো, প্রয়োজনীয় গবেষণাগার, পাঠাগার কিছুই গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণে শিক্ষাকে পুঁজি করে বাণিজ্য ও বেসরকারিকরণের হার বাড়ছে।

সপ্তমত, যেসব দেশের শিক্ষাক্রমের উদাহরণ টেনে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে সেসব দেশে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংযুক্ত রেখেই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হয়। সবার মতামতের ভিত্তিতে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা পর্যালোচনা তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষাক্রম তৈরি ও বাস্তবায়ন উপর থেকে জোরজবরদস্তি করে চাপিয়ে দেয়া হয়।

অষ্টমত, উপরোল্লেখিত দেশগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের দুষ্ট প্রভাব কাজ করে না। অথচ আমাদের দেশে এগুলো এত বেশি যে এর কারণে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেক সময় শিক্ষকরাও লাঞ্ছিত হন। প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানদের বিশেষ সুবিধা না দিলে শিক্ষকদেরই বিপদ হয়। পরীক্ষাতেও তাদের বাড়তি সুবিধা দিতে হয়। শিক্ষকরা তাদের দায়িত্বপালন করবেন কিভাবে সেটিও বড় প্রশ্ন এক্ষেত্রে। ত্রিভুজ, বৃত্ত দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে? পরিচালনা ব্যবস্থাই বদলাতে হবে।  

বেতনবৈষম্য, দুর্বল অবকাঠামো, শিক্ষকের অভাব, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অসম অনুপাত এবং বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়াবহ বৈষম্য শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা, এ বিষয়গুলো অস্বীকারের অবকাশ নেই। এসব মৌলিক প্রতিবন্ধকতা দূর না করে কোনো টেকসই পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব? অস্বচ্ছতা ও জবরদস্তির কারণে শিক্ষাচেতনা বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপতৎপরতা তৈরি হচ্ছে। শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষকদের আর্থিক দুরবস্থা দূর করার পাশাপাশি পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিত করা জরুরি। নিম্নমানের পাঠ্যপুস্তক, নকল কিংবা ভুল বিষয়বস্তু, বিজ্ঞান, গণিতে দুর্বলতা এগুলো নতুন শিক্ষাক্রমের ক্ষেত্রেও অভিযোগ হিসেবে এসেছে। এসব বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবই পরিস্থিতিকে জটিল করছেএই সত্যও এড়িয়ে যাওয়ার কোনোই অবকাশ নেই। মূল সমস্যা টিকিয়ে রেখে নানাধরনের সৌখিন ও ব্যয়বহুল পরীক্ষানিরীক্ষা বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের জন্য শুধু নয়, পুরো দেশের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে। আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য মানসম্পন্ন আনন্দময় জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশে অভিন্ন শিক্ষা চাই

  • অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা