দায়িত্বহীনতা
নাউন হলো সেই
শব্দ, যা দ্বারা কোনো কিছুর নাম বোঝায়। সেটা ব্যক্তি, স্থান বা বস্তু হতে পারে। ছেলেবেলায়
নাউনের ধরনে শেখানো হয়েছে, ব্যক্তির নাম প্রপার নাউন। প্রপার নাউনে কোনো ভুল নেই। মানে
ব্যক্তির নাম, তা যেভাবেই, যে বানানেই লেখা হোকÑ ভুল নয়। এই যে শিক্ষা, তা-ই হয়তো আমাদের
মাথায় গেঁথে রয়েছে। সিন্দাবাদের সেই দৈত্য আর কাঁধ থেকে নামছেই না বা আমরাও দৈত্যকে
নামাতে আগ্রহী না। নিজের নামের বানানে দৈত্যকে নামিয়ে ফেললেও অন্যের বিষয়েও যে তা যথাযথভাবে
নামানো উচিত, সেই উচিত কর্মটি করতেই আমাদের যত অনীহা। তারই একটি উদাহরণ উঠে এসেছে
৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। ‘পাবনার এক উপজেলায় অর্ধেকের
বেশি স্মার্ট কার্ডে ভুল’ শীর্ষক শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কারও কার্ডে নাম
ভুল, কারও জন্ম তারিখ, আবার কারও বাবা-মার নাম বা ঠিকানায় ভুল। এদের মধ্যে অনেকের স্মার্ট
কার্ডে গ্রাম বা রাস্তার স্থানে ভাঙ্গুড়া বাজার, ভাঙ্গুরা বাজার, ডাকঘরের স্থানে ভাঙগুড়া-৬৬৪০,
ভাংগুড়া ও পৌরসভার নাম ভাঙ্গুরা লেখা হয়েছে।’ ভুক্তভোগীরা ভুলের জন্য প্রতিবেদকের কাছে
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতাকে দায়ী করছেন।
কেন এমন ভুলে
ভরা থাকবে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদ? এর পেছনে দায় কার? কেন অন্যের ভুলের মাশুল
গুনতে উপকারভোগীকেই দিশেহারা হয়ে খুঁজতে হবে চতুর্দিকে সমস্যা সমাধানের পথ? আর সে সুযোগে
‘টু-পাইস’ কামানোর ধান্দায় দাঁড়িয়ে যাবে দালালশ্রেণি। ভোটার আইডি কার্ডে নাম-ঠিকানা
লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। এরও অনেক পরে শুরু হয় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কম্পিউটার কম্পোজের দোকান এবং দালালশ্রেণির সঙ্গে তথ্য ইনপুটকারীদের
যোগসাজশেই নামের বানান নিয়ে চলে তুঘলকি কাণ্ড। যার মাশুল দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। নাম
বিকৃতির অপরাধকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। যারা নাগরিকের তথ্য ইনপুটের দায়িত্ব পালন
করছেন, নিয়োগের সময়ে তাদের যোগ্যতা কি যথাযথভাবে দেখা হয়? তাদের কাজের গাফিলতির জন্য,
ভুল তথ্য ইনপুটের জন্য কোথাও কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নজির রয়েছে? উত্তর স্বাভাবিকভাবেই
নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কা বেশি। আর নেতিবাচক বলেই ভুলের এই ছড়াছড়ি। আমাদের জন্ম-মৃত্যু
নিবন্ধন এবং ভোটার তথ্য ইনপুটের দায়িত্ব যারা পালন করেন, তাদের ধৈর্য কম, এমন অভিযোগ
আছে। আবার তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়ার
তথ্য ইনপুটের দায়িত্ব স্ব-স্ব ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনের। ভুল তথ্য সংশোধন করতে
চাইলে আবার তাদের কাছেই যেতে হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াটি সহজও নয়। আবার ভোটার তথ্য ইনপুটের
দায়িত্বও উপজেলা পর্যায়েই। ফলে ভুল সংশোধনের জন্য ধরনা দিতে হয়ে সেখানেও এবং এর সুযোগ
নিচ্ছে একশ্রেণির দালাল।
নাম মানুষের পরিচয়।
মানুষকে চেনার উপায়। সৃষ্টিশীল মানুষ তো বটেই, সব মানুষেরই ছুটে চলা এই নামের পেছনে।
কারণ ব্যক্তি মানুষ সময়ের গহ্বরে হারিয়ে গেলেও রয়ে যায় তার কীর্তি। সেই কীর্তি ভবিষ্যৎ
মনে রাখে নামের মাধ্যমে। সুন্দর ও নির্ভুল নাম শিশুর অধিকার, তা যেমন সামাজিক-রাষ্ট্রীয়
অধিকার; তেমনি ধর্মীয়ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম ধর্মাবলম্বী শিশুর জন্মের সপ্তম দিনে
আকিকা করে নাম রাখার বিধান থাকলেও, নির্দিষ্ট দিনেই তা বাধ্যতামূলক নয়। ফলে অধিকংশ
সময়েই সুবিধাজনক সময়ে পরিবারের সদস্যরা আকিকার মাধ্যমে সন্তানের নাম রাখেন এবং দোয়া
করেন। হাসপাতাল বা বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাদের জন্ম, তাদের অধিকাংশেরই তাৎক্ষণিক
নাম দেওয়া হয় না। হাসপাতালের ছাড়পত্র নেওয়ার সময় শিশুর নাম লাগে। অধিকাংশ সময়ে শিশুর
নাম নির্ধারণ না করায় শুধু ‘বেবি’ লিখেও ছাড়পত্র নেওয়ার উদাহরণও কিন্তু প্রচুর। প্রত্যন্ত
গ্রামেও ঘরে বর্তমান জামানায় প্রসূতি মায়ের সন্তান প্রসব করানোর সংখ্যা কমেছে। যদি
হয়, সেখানেও শিশুর তাৎক্ষণিক নাম রাখার উদাহরণ হাতের আঙুলে গোনা যাবে। জন্মের ছয় মাসের
মধ্যে শিশুকে প্রাণঘাতী ছয়টি মারাত্মক রোগ থেকে সুরক্ষায় টিকা দেওয়া হয়। এজন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র
থেকে দেওয়া হয় শিশুর নামের একটি কার্ড, যা টিকা কার্ড নামেই পরিচিত। টিকা কার্ডে শিশুর
নাম, পিতা-মাতার নাম, বয়স এবং কোন কোন তারিখে শিশু কোন কোন টিকা পাবে, তারই তালিকা
থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুর টিকা দেওয়ার শুরুর সময়ে তো বটেই, টিকা শেষ হয়ে
যাওয়ার পরও শিশুর পরিবার আকিকা সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি। ফলে শিশুর ডাক নামই রয়ে যায়
টিকা কার্ডে।
শিশুকে স্কুলে
ভর্তি করানোর সময় সাধারণত বাবা-মা সচেতন হয়ে ওঠেন শিশুর পূর্ণ নাম প্রসঙ্গে। তখন তোড়জোড়
করা হয়। শিশুকে একটি সুন্দর নামসহ স্কুলে ভর্তি করানো হয়। প্রাক-প্রাথমিকে শিশু ভর্তির
জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় এদিকটিতে অনেক পিতা-মাতা নজর দেন না। কিন্তু
যখন নজর দেন, তখনই বাধে বিপত্তি। কারণ জন্মনিবন্ধনের জন্য লাগবে টিকা কার্ড, হাসপাতালের
ছাড়পত্র। যেখানে শিশুর পুরো নাম নেই। আর নেই বলেই, জন্মনিবন্ধন সনদে নাম ভুল হলে আর
রক্ষা নেই। সেই অভিভাবকের তখন ঘুম হারাম হতে বাধ্য। আবার স্কুলে ভর্তিতেও রয়েছে শুভঙ্করের
ফাঁকির খেলা। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির জন্য শিশুর বয়স হতে হয় ৬ অথবা ৬-এর ঊর্ধ্বে। তৃতীয়
শ্রেণিতে হতে হয় ৯ অথবা ৯-এর উর্ধ্বে। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চসীমা
৩০। তাই না চাইলেও অনেক বাবা-মা সন্তানের জন্মতারিখ নিয়ে নয়ছয় করেন। কারণ যে শিশুর
বয়স ৫ বছর ১১ মাস ২৯ দিন। সে শিশুটিও কিন্তু বয়স নির্ধারণের ফেরে স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে
ভর্তির জন্য বিবেচিত হয় না। তাকে অপেক্ষা করতে হয় পরের বছরের জন্য। এই বিষয়গুলোর দিকেও
নজর দেওয়ার সময় এসেছে। আমরা একটি পরিপূর্ণ কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করছি, সেই যাত্রাপথে
এ রকম সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর সমাধান জরুরি।
জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রে বানান ভুলের বিষয়টি সুখকর তো নয়ই, নাগরিক সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বড় অন্তরায়। সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরিষেবার উদ্যোগ নিয়েছে, বানান ভুলের কারণে ব্যক্তির ক্ষেত্রে তাও কিন্তু ভেস্তে যাচ্ছে। এই দায়িত্বহীনতার দায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কারোরই এড়ানোর অবকাশ নেই। এ ছাড়া সমাজের দরিদ্রতম শ্রেণির মানুষ, যারা নিজের নামের বানান সম্পর্কে সচেতন না, তাদের কার্ডের ক্ষেত্রে কতটা খামখেয়ালিপনা করা হয়েছে, তারও অনুসন্ধান জরুরি। বাংলাদেশে এক ডজনেরও বেশি নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্যও জন্মনিবন্ধন সনদ গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ দুটি প্রক্রিয়াতেই যেভাবে ভুলের ছড়াছড়ি হচ্ছে ও হয়, যেখানে মানুষের অধিকারের প্রশ্ন জড়িত, সেখানে তো এমন ঔদাসীন্যের সুযোগ নেই। এজন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করারও বিকল্প নেই। ‘জিরো টলারেন্স’ শব্দটি সব ক্ষেত্রেই শুধু কথার কথা না হোক, তা কাজে পরিণত হোক। এই অঙ্গীকার যদি আমরা স্মরণে রাখতে পারি তাহলেই মঙ্গল।