সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৫২ এএম
যেকোনো দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ব্যাংক খাত। এমনও বলা
হয়, ব্যাংক খাত অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। হৃৎপিণ্ডে রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক থাকলে শরীর যেমন
সুস্থ থাকে তেমনি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা-স্বচ্ছতা-গতিশীলতা একই সঙ্গে পুষ্টতা অর্থনীতির
রক্তসঞ্চালনও স্বাভাবিক রাখে। ফিরে ফিরে নেতিবাচক অর্থে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে খাতটির
নানা অসঙ্গতি। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ফের এরই প্রতিফলন দেখা গেছে। ১০
ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদরা
ব্যাংক খাত সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। তাদের কারও
কারও অভিমত, অন্যের পরামর্শে বাস্তবতাবিবর্জিত ও প্রভাবিত সিদ্ধান্তের কারণে দেশের
ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাবে সার্বিক অর্থনীতিতে বিরাজ করছে অস্থিরতা।
আরও উদ্বেগজনক বার্তা হলো, প্রভাবশালীদের সুবিধার্থে অনেক নীতি প্রণয়ন এবং ছাড় দেওয়া
হয়, যা পরবর্তী সময়ে আবার পরিবর্তনও করতে হয়। এর ফলে এক ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার আগেই ফের
নতুন ক্ষতির বার্তা এসে হাজির হয়।
আমরা জানি, আমাদের অর্থনীতি তথা ব্যাংক খাতের অন্যতম উপসর্গ খেলাপি
ঋণ। প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর ভিন্ন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলো
তাদের আর্থিক চিত্র কৌশলে ভালো দেখাচ্ছে। আমরা মনে করি, এই কৌশল আত্মঘাতীর নামান্তর।
‘গতি নেই অবলোপন ঋণ আদায়ে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাইট অফ তথা অবলোপন
পদ্ধতিতে হিসাবের খাতা থেকে খেলাপি ঋণ বাদ দিয়ে ব্যাংকের আর্থিক চিত্র ভালো দেখানোর
ফল ভালো হতে পারে না। বিগত বছরগুলোতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবলোপন ঋণ আদায় হতাশাজনক।
কৌশলে ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো দেখিয়ে মূল সমস্যা অন্তরালে রেখে অর্থনীতিকে
আরও ঝুঁকির মুখে ফেলা হচ্ছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফে নানারকম
সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বটে কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, এর তেমন কোনো সুফল দৃশ্যমান
হয়নি। লাগামহীন খেলাপি ঋণ, সুশাসনের ঘাটতি, ডলার সংকট ও সাধারণ মানুষের আস্থা ব্যাংকের
ওপর থেকে ক্রমেই কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি গোপালগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের প্রধান শাখায় কয়েকজন
গ্রাহকের টাকা ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে নয়-ছয়ের বিষয়টি চরম উদ্বেগজনক। এমন ঘটনা
এর আগেও ঘটেছে কিন্তু প্রতিবিধান কতটা কী হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। অর্থ পাচার আমাদের
অর্থনীতি তথা জাতীয় স্বার্থের জন্য আরও বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ থেকে অর্থ
পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের
নামে লোপাট করা হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ফলে তারল্য সংকটসহ নানামুখী জটিলতার মুখোমুখি
হতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। ব্যাংকে যে টাকা জমা থাকে তা জনগণের টাকা। টাকা ব্যয়ের খাত
অবশ্যই সুবিবেচনার বিষয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংক খাতে নিয়ম-কানুনের বাস্তবায়ন ও সংস্কারের
পাশাপাশি স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির কোনো বিকল্প নেই। খেলাপি ঋণের সঙ্গে জড়িতরাই ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের
নিয়ম করে দেন এই অভিযোগও নতুন নয়। আমরা জানি, চলমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে আমাদের
অর্থনীতিও অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং এর সুরাহা খুব দ্রুত হবে বিদ্যমান
বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তেমনটিও আশা করা যায় না।
ব্যাংক খাতের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি, বহিঃ খাত ও শ্রম খাত অর্থনীতির
সূচকগুলো যেহেতু আশাব্যঞ্জক নয় এমতাবস্থায় ভারসাম্যপূর্ণ সুব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প
নেই। নতুন করে খেলাপি ঋণের বোঝা যেন আরও স্ফীত না হয় সেজন্য ব্যাংকগুলোর সতর্কতার পাশাপাশি
খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর নেই। সংবাদমাধ্যমেই উঠে এসেছে,
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট অনেকটাই ব্যাংক খাত
থেকে সৃষ্ট। এই অবস্থায় আমরা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করার
যে প্রস্তাব ইতঃপূর্বে উঠে এসেছে তা নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি। ব্যাংক খাতে
সংস্কারের প্রশ্নে সব ধরনের প্রভাববলয় কীভাবে মোকাবিলা করা হবে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা
হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সরকারই কতটা দৃঢ় মনোভাব দেখাবে তা দেখার বিষয়। ‘আইনের
চোখে সবাই সমান’Ñ এই নীতির প্রতিপালনেই কেবল সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অনিয়মকারী
কাউকে যেমন কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না তেমনি প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে কেউ যাতে নিজেদের
ফায়দা লুটে না নেন সেদিকেও মনোযোগ গভীর করতে হবে।
আমাদের বিভিন্ন খাতে জবাবদিহি সংস্কৃতির অনুশীলন হয় না। আমরা বিশ্বাস
করি, সুনীতি-জবাবদিহির সংস্কৃতি অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যবস্থা পরিশীলিত করা কঠিন কিছু
নয়। প্রভাবমুক্তভাবে আইনি কাঠামোর মধ্যে ব্যাংকগুলো যাতে কাজ করতে পারে তাও নিশ্চিত
করা জরুরি। আমরা দেখছি, কোনো কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বশীলরাই বৈরী ভূমিকা
পালন করছেন। ইতোমধ্যে এমন কারও কারও অনাচার-দুরাচারে কয়েকটি ব্যাংক অতিরুগ্ণ হয়ে পড়েছে।
আমাদের অর্থনীতির যেমন সংকট আছে তেমনি সম্ভাবনাও কম নয়। কিন্তু এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে
প্রয়োজন সুচারু ব্যবস্থাপনা। ব্যবস্থাপনায় গলদ রেখে ভালো কিছু আশা করা দুরাশারই নামান্তর।
ইতঃপূর্বে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছি, আর্থিক খাতে বিশেষ করে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা
ফেরানোর পাশাপাশি কমাতে হবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং নজর রাখতে হবে দেশি-বিদেশি ঋণের দায়
পরিশোধের দিকে। সব মিলিয়ে বিষয়টি যে কঠিন চ্যালেঞ্জের তা অস্বীকার করা যাবে না।
অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং স্বচ্ছতাও
জরুরি। অর্থনীতির চাকা যদি সচল না থাকে তাহলে এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হবে
এটাই স্বাভাবিক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মাথাচাড়া
দিয়ে উঠেছিল সংকটকালে এরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। আমরা মনে করি, নীতির ভুল
সংশোধনের পাশাপাশি রাজনীতিকদেরও জাতীয় স্বার্থের ব্যাপারে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে
উঠতে হবে।