বৈশ্বিক সম্পর্ক
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:৫০ এএম
ড. ফরিদুল আলম
৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর অবশেষে প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জো বাইডেন প্রেরিত
শুভেচ্ছাবার্তায় নতুন সরকারের জন্য অভিনন্দন বা শুভকামনা জাতীয় কিছু না থাকলেও আগামী
দিনগুলোয় পারস্পরিক অংশীদারির ভিত্তিতে একসঙ্গে কাজ করে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা
হয়। এদিকে বাইডেনের শুভেচ্ছাবার্তার তিন দিনের মাথায় ৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী
ঋষি সুনাক এক অভিনন্দনবার্তায় শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের
অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা অংশীদারি জোরদারকরণে একত্রে কাজ করে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত
করেন। মজার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাজ্য সরকার এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের দিকে
তাকিয়ে থাকলেও ঋষি সুনাকের বার্তাটি ছিল উৎসাহব্যঞ্জক এবং দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের
আলোকে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বার্তাটি থেকে যে বিষয়টি
আমরা অনুধাবন করতে পারি তা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে যুক্তরাষ্ট্রের
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অপরিহার্যতা। এ ক্ষেত্রে বাইডেনের
দেরিতে প্রেরিত চিঠিটি আমরা এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি : যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হয়তো
ভেবে থাকতে পারে নির্বাচনোত্তর শেখ হাসিনার সরকার গঠনে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধকতার
সৃষ্টি করা হতে পারে এবং সম্ভবত তারা এ ধরনের কিছু ঘটার জন্য অধীর আগ্রহে অপক্ষায় ছিল।
আর সেটাই সম্ভবত বিলম্বে শুভেচ্ছা জানানোর একটি কারণ হিসেবে ভাবা যেতে পারে।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠি বিশ্লেষণে মার্কিন সরকারের দিক থেকে কিছুটা অস্বস্তিও
লক্ষ করা যায়। যে কথাটি আগেই বলেছি, বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে
কোনো ধরনের ‘অভিনন্দন’সূচক কিছু লেখেননি। অন্যদিকে চিঠির সামগ্রিক বিশ্লেষণে তিনি আবার
এও লিখতে কার্পণ্য করেননি, ‘সমস্যা সমাধানে আমাদের একসঙ্গে কাজ করার দীর্ঘ ও সফল ইতিহাস
রয়েছে।’ এ কথার মধ্য দিয়ে তিনি কি বর্তমান সরকারের বিগত বছরগুলোর কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি
দিলেন না? তিনি আরও লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার অংশীদারির পরবর্তী
ধাপ শুরুর আগে আমি বলতে চাই, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু
পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ
আরও অনেক ইস্যুতে আমাদের প্রশাসনের একসঙ্গে কাজ করার ঐকান্তিক ইচ্ছা আমি তুলে ধরছি।’
এ ক্ষেত্রে বাইডেন কার্যত স্বীকৃতি দিলেন, তাদের ভাষায় যা কিছু ভালো এবং যুক্তরাষ্ট্র
সরকারের তথাকথিত মানবাধিকার নীতিকে সমর্থন করে এর সবকিছুতেই কাজ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
এ ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে
বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দনবার্তা জানিয়ে নির্বাচনের পরপরই চিঠি দেওয়া হলো না। আসলে
এখানে ভুলটা তারা নিজেরাই করে ফেলেছেন এবং তারা ধীরে ধীরে এ ভুল থেকে বের হয়ে আসতে
চাইছেন। তারা সবচেয়ে বড় যে ভুলটি করেছেন তা হলো ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পরপরই এর স্বচ্ছতা
নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টির কথা জানানো। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত
পিটার হাসও তার এক প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন তাদের দৃষ্টিতে সন্তোষজনক না হলেও আগামী দিনগুলোয়
দুই দেশ একত্রে কাজ করে যাবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের ভাষায় যদি
সরকারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অক্ষুণ্নই না থাকে, তাহলে তারা কেনই বা একত্রে কাজ করতে
সম্মত হবে? এর কারণ একটাই, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ছাড়াও
চীন ও রাশিয়ার সুসম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র
নিতে পারছে না বা নিতে চাইছে না। আর সেজন্যই তাদের তরফে বিভিন্ন সময়ে মানবাধিকার ও
গণতন্ত্র নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য প্রকাশ করা হচ্ছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক রাষ্ট্র যেখানে আমাদের
অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এ ক্ষেত্রে সরাসরি কোনো অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত থেকেছিল, যুক্তরাষ্ট্র
সে ক্ষেত্রে এক ধরনের অনমনীয় নীতি নিয়ে কয়েকটি বিরোধী দলের ভাষায় কথা বলে আসছিল। এর
জেরেই গত বছর ২৪ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের জন্য সে দেশের
নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচনে বাধাদানের ক্ষেত্রে
এ নীতির কঠোর প্রয়োগের ঘোষণা দেন। ব্লিঙ্কেনের এ ঘোষণার পর আমরা দেখেছি একই বছরের ২৮
অক্টোবর বিএনপির নেতৃত্বে ব্যাপক বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড শুরু হলেও এ ক্ষেত্রে ঘোষিত ভিসানীতির
কোনো ধরনের প্রয়োগ তারা ঘটায়নি। উপরন্তু সেপ্টেম্বরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষ
থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়। আমরা বাস্তবে
এর কোনোটাই ঘটতে দেখলাম না। প্রথমটা, অর্থাৎ ভিসানীতির প্রয়োগ না ঘটানোর পেছনে বলা
যায়, এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বিএনপি নেতাদের ওপরই এর প্রয়োগ করতে হতো বলে তা এড়িয়ে যাওয়া
হয়েছে। অবশ্য পরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে কৌশল পরিবর্তন করে জানানো হয় ভিসানীতি
কবে, কখন, কার বিরুদ্ধে তারা আরোপ করবে সেটা গোপনীয় থাকে। আমাদের স্মরণে আছে, ২০২১
সালের ডিসেম্বরে যখন তারা বাংলাদেশের কতিপয় আইন প্রয়োগকারী সদস্যের বিরুদ্ধে এ নীতি
আরোপ করে, তখন কিন্তু তা গোপন ছিল না! দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত,
যেখানে আমরা নির্বাচনের আগেও লক্ষ করেছি মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি পোশাক কারখানায়
কর্মরত শ্রমিকদের বিক্ষোভ ইস্যু কাজে লাগিয়ে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি যখন তারা
নিচ্ছিল, এমন অবস্থায় তাদের অভ্যন্তরের আমদানিকারকদের প্রবল প্রতিবন্ধকতার কারণে তা
করা সম্ভব হয়নি। ফলে কার্যত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তারা তাদের কোনো ধরনের পরিকল্পনাই
যখন কাজে লাগাতে পারেনি, এ অবস্থায় নতুন সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করার আশাবাদের কথা
জানিয়েছে।
এ ক্ষেত্রে বলতে চাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী সার্বিক বিষয়ে অত্যন্ত দূরদর্শিতা এবং
বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে নির্বাচন এবং মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে যখন
তাদের পক্ষ থেকে একের পর এক চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল, বাংলাদেশ সরকার কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের
এ ধরনের চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে নিজের অবস্থানে অবিচল ছিল। অতীতের সরকারগুলোকে
আমরা দেখেছি, আমাদের জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে অন্ধভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে
নিজেদের সমর্পণ করে রাখা হতো, এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সময়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থ
এবং আত্মমর্যাদাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর তাই যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতিকে
একমাত্র উপজীব্য না করে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের আদলে এক ধরনের
ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি রক্ষা করে চলা হচ্ছে।
বাইডেনের চিঠি থেকে খুব স্পষ্ট করে যে বিষয়টি আমরা তুলে আনতে পারি তা হচ্ছে ভারত-প্রশান্ত
মহাসাগরীয় কৌশলে বাংলাদেশের অপরিহার্যতার প্রসঙ্গটি। আর এ ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের
উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ অর্জনে সমর্থন এবং একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয়
অঞ্চল প্রতিষ্ঠার অভিন্ন স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ আমরা বলতে পারি তাদের ভাষায় তথাকথিত ‘একটি অবাধ ও মুক্ত ভারত-প্রশান্ত
মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠা’র বিষয়টি আসলে কোনোকালেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারের
বিষয় ছিল না, বরং এটি আসলে তাদের পক্ষ থেকে এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, যার মূল লক্ষ্য
হচ্ছে এ অঞ্চলে চীনের আধিপত্য হ্রাস করতে নিজেদের মতো করে একটি জোট গঠন করা। বাংলাদেশ
বরাবরই এ ক্ষেত্রে তার শৈথিল্য দেখিয়েছে এবং প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সঙ্গে যেকোনো ধরনের
বিভেদ এড়িয়ে এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ অনুসরণের চেষ্টা করেছে।
উপরোক্ত বিষয়ের বিবেচনায় বাংলাদেশের নির্বাচনের পরপরই যখন প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে
চীন এবং সেই সঙ্গে রাশিয়ার মতো দেশ নতুন সরকারকে স্বাগত জানিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অভিপ্রায়
ব্যক্ত করল, যুক্তরাষ্ট্রের আর বুঝতে বাকি রইল না সবকিছু ভুল হয়ে গেছে এবং অনেক দেরি
হয়ে গেছে। আর তাই তারা তাদের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে একে এক অভিন্ন
স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় বলে কার্যত নতুন করে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব সৃষ্টির
পাঁয়তারা করছে।
গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের নীতি আওড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজনীতি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। দেশটির গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকারের সব নীতিকেই তারা সমর্থন জানিয়ে আসছে। এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কিছু হতে পারে না। সুতরাং বাইডেনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানকে পাঠানো চিঠি নিয়ে বলতে হয়, এটি আসলে আমাদের জাতীয় জীবনে কোনো ধরনের তৎপর্য বহন করে না, বরং তাদের মানসিক দৈন্যই প্রবলভাবে ফুটিয়ে তোলে। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এখন অনেক বেড়েছে এবং ধারাবাহিক টানা চার মেয়াদসহ পঞ্চমবারের মতো শেখ হাসিনা সরকারের তা বড় সাফল্য।