× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভাষার মাস

অসমীয়া ভাষার বর্ণমালা বাংলা

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৩৪ এএম

মযহারুল ইসলাম বাবলা

মযহারুল ইসলাম বাবলা

আমাদের ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপট বা এর পূর্বাপর বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে প্রসঙ্গক্রমে আরও কিছু বিষয় সামনে আসে। আজকের লেখার বিষয় তা-ই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসাম রাজ্যে বাঙালি ও অসমীয়া ভাষাভাষীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব নতুন নয়। দুই ভাষাভাষীর মধ্যকার জাতীয়তার সংকট দীর্ঘকাল পরস্পরের প্রতিপক্ষ। আসামের সরকারি ভাষা বাংলা নয়, অসমীয়া। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৮.৩৮ জন অসমীয়া, ২৯ জন বাঙালি, ২.১৫ জন বোড়ো, ৫.৯৭ জন নেপালি ও হিন্দিভাষী এবং অন্যান্য ৯.৬ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাঙালি মুসলমানের মধ্যেই অধিক। ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে ভারতের সংযুক্তির একমাত্র স্থলপথটি আসাম রাজ্যের মধ্য দিয়ে। ত্রিপুরা রাজ্যে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকেই বাংলা ভাষা রাজভাষা হিসেবে প্রচলিত। ত্রিপুরাসংলগ্ন আসামের ভাষা-সংকট, ভাষা-দাঙ্গা অনেক কালের।

ওদিকে আবার আসামের অধিবাসীরা প্রধানত দুই পৃথক অঞ্চলে শতাব্দীর অধিককাল ধরে বসবাস করে আসছেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমীয়রা একক সংখ্যাগরিষ্ঠ, পাশাপাশি বাঙালিও সেখানে রয়েছেন লক্ষাধিক। অন্যদিকে বরাক উপত্যকা জুড়ে রয়েছেন কেবল বাঙালি। তবে কিছু মণিপুরিও সেখানে বসবাস করেন। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকায় অসমীয়া ও বাঙালি এ দুই জাতির প্রাধান্যে অসমীয়াদের বাঙালিবিদ্বেষ বহুপূর্ব থেকেই। তবে আসাম অসমীয়দের একক অঞ্চল অতীতেও ছিল না। আজও নয়। আসামের বাঙালিরা রাজ্যের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের সমর্থকরূপে কংগ্রেসের ছায়াতলে ছিলেন। কংগ্রেসও নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে আসামের ভোটব্যাংক বাঙালির পাশে থাকলেও রাজনৈতিক স্বার্থে অসমীয়া জাত্যাভিমানকেও কাছে টানতে চেয়েছে।  বড় অন্যায় ঘটে ১৯৬১ সালে রাজ্যের কংগ্রেস সরকার যখন বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের সশস্ত্র পন্থায় দমন করে। আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ১১ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। কংগ্রেস দ্রুত নিজেদের শুধরে নিলেও আসামের বাংলা ভাষা আন্দোলনে আত্মদানকারীদের স্মৃতি বাঙালির মানস এবং ভারতের ভাষাগত সংগ্রামের ইতিহাস থেকে মুছে যায়নি। আজও ওই দিনটি বাংলাভাষীরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন।

আসামে কংগ্রেসকে হটিয়ে ক্ষমতা লাভ করে বিজেপি। ক্ষমতা দখলের পর তারা অসমীয়া ও বাংলাভাষীদের মধ্যকার দীর্ঘদিনের বিদ্বেষের ফায়দা হাসিলে জাতিবিদ্বেষী চক্রান্ত সামনে নিয়ে আসে। অসমীয়দের বিদেশি হটাও আন্দোলনে ওই রাজ্যের সরকারের জনগোষ্ঠীর একাংশকে সুবিধা দিয়ে অন্যদের অধিকার বঞ্চিত করার বিষয়ও পুরানো। এক কথায় ভাষাগত বিরোধ সাম্প্রদায়িক বিরোধে পরিণত করে দাঙ্গার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। ভোটের রাজনীতিতে ভোটের সময় তা যেন আরও তাপ পায়।

ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসাম ছিল স্বতন্ত্র একটি প্রদেশ। বাংলাদেশের সিলেট জেলা ছিল আসামের অন্তর্ভুক্ত। ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা এবং স্বতন্ত্র আসামকে একীভূত করে ‘ইস্টার্ন বেঙ্গল’ নামে একটি পৃথক প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল বাঙালি বিভক্তির অভিপ্রায়ে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে আসাম পুনরায় স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হয়। অন্যদিকে অখণ্ড বাংলা প্রদেশ থেকে বিহার, ওড়িশা ও ছোট নাগপুরকে বিচ্যুত করে বাংলা প্রদেশকে সংকুচিত করা হয়। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত করা হয় দিল্লিতে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি বিষয়ে অগ্রসর চেতনাই বাঙালির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৭ সালের দেশভাগে বৃহত্তর সিলেটের বড় অংশ আসাম প্রদেশের অংশ হয়ে গেল। এ অংশে বসবাসকারী সবার ভাষাই ছিল বাংলা। আজ আসামে যাদের বহিরাগত বাঙালি বলা হচ্ছে বৃহত্তর সিলেট খণ্ডনের আগে তারা বহিরাগত ছিলেন না, বংশপরম্পরায় নিজ মাতৃভূমিতেই ছিল তাদের বসবাস। ভাষা ও জাতীয়তার বিদ্বেষে অসমীয়রা তাদের মেনে নিতে অতীতেও পারেনি, আজও পারছে না।

ভারতবর্ষে অসমীয়রা পৃথক ভাষাসংস্কৃতির স্বতন্ত্র এক জাতি। তাদের ভাষা-বর্ণমালাও নিজস্ব। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা অতীতে কখনোই বিদেশি মৌর্য, গুপ্ত বা মুসলিম শাসনাধীনে ছিল না। ১৮২৬ সালের আগে ব্রিটিশরাও আসামে প্রবেশ করতে পারেনি। ১৮২৬ সালে কাছাড়ের দিক দিয়ে বর্মী-মগদের আগ্রাসনের মুখে অহোম রাজ্য উদ্ধারে অসমীয়দের আমন্ত্রণে ইংরেজরা আসামে প্রবেশের সুযোগ পায়। বর্মী-মগদের বিতাড়নে ইংরেজদের সামরিক সাহায্য গ্রহণের পরিণামে আসাম ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে যায়। ১৮৩২ সালে অহোম রাজ্যের সিংহাসনে ব্রিটিশরা রাজবংশের এক প্রতিনিধিকে বসিয়ে দেয়। আর এর মাত্র চার বছর পরই কিন্তু ইংরেজ শাসকরা রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে আসাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে নিয়ে নেয়। অহোম রাজ্যের ভাষা ছিল অসমীয়া। অসমীয়া ভাষায় সাহিত্য-সংস্কৃতি ছিল উন্নতমানের। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমীয়াদের নিজস্ব ঐতিহ্য-ইতিহাসের নির্দশন রয়েছে। ভারতবর্ষের মৌর্য, গুপ্ত, মুসলিম, ব্রিটিশ শাসনের যুগের সঙ্গে যার কোনো সাদৃশ্য ছিল না। ১৮৩৬ সালের আগে অসমীয়া ভাষায় রাজ্যের ইতিহাস রচিত হয়েছিল। ১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক অসমীয়া ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষা আসামের সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। শিক্ষাঙ্গনে ও আদালতে অসমীয়া ভাষা পরিত্যক্ত হয়ে বাংলা সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করে। প্রত্যেকের মাতৃভাষাই তো মর্যাদা-ভালোবাসার।

১৮১৭ সালে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি কর্তৃপক্ষ অসমীয়া ভাষায় অনূদিত বাইবেল বাংলা অক্ষরে ছেপে প্রকাশ করে। এতে পরবর্তীতে প্রমাণ করা সহজ হয় যে বাংলা বর্ণমালাই অসমীয়া বর্ণমালা। একমাত্র ‘র’ ছাড়া অসমীয়া বর্ণমালায় আর কোনো পৃথক বৈশিষ্ট্য নেই। অসমীয়া ভাষা বাংলা ভাষার উপভাষার অমর্যাদায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ওড়িশায়ও বাঙালি আমলারা উড়িয়া ভাষার ক্ষেত্রে একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু সফল হয়নি। আসামে অসমীয়া ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা হারানোর দরুন অসমীয়রা বাংলা ভাষা ও বাঙালি বিদ্বেষী হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের আসাম রাজ্য দখলদারিতে অসমীয়রা পরাজিত হলো ইংরেজদের দ্বারা, বাঙালিদের দ্বারাও। অসমীয়া ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য খ্রিস্টান মিশনারিরা আন্দোলন করেন। অসমীয়া ভাষায় বই লিখে ও প্রকাশ করে তারা প্রমাণ করে যে অসমীয়া একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র ভাষা। বাংলা ভাষার উপভাষা নয়। কলকাতার হিন্দু কলেজ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন ওই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। অবশেষে ব্রিটিশ শাসকরা অসমীয় অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে অসমীয়া ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদান করে। তবে সামান্য হেরফেরে প্রবর্তিত অসমীয়া ভাষার বর্ণমালা বাংলাই রয়ে যায়। 

  • নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা