পরিপার্শ্ব
আবু সালেহ আহমেদ
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:৪০ এএম
বিশ্বের কয়েকটি ক্ষুদ্রাকার স্বাধীন রাষ্ট্রের চেয়ে লোকসংখ্যা
ও আয়তনে অনেক বড় এক কালের স্বাধীন ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং। হবিগঞ্জ জেলা
সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তর এবং কিশোরগঞ্জের পুবপ্রান্ত থেকে ১২ কিলোমিটার
দূরে প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬ কিলোমিটার প্রস্থের বিরাট স্থলভাগবিশিষ্ট এ
গ্রামটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী নন্দিত। চতুর্দশ শতাব্দীর
প্রথম ভাগে সিলেটের ইতিহাসে লাউড়, গৌড়, জৈন্তা- তিনটি রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। দার্শনিক
জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ উল্লেখ করেন, ‘এ লাউড় রাজ্যের রাজধানী ছিল
বানিয়াচং। রাজা কেশর মিশ্র ছিলেন এ রাজ্যের আদি রাজা। তার পরবর্তী বংশধররা
বানিয়াচংয়ে লাউড়ের রাজধানী স্থাপন করেন। তখন বানিয়াচংয়ের অধীনে ২৮টি পরগনা
বিদ্যমান ছিল।’
বানিয়াচং রাজবাড়ি ও রাজাদের কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে অনেক
কিংবদন্তি (যা আমার ঐতিহাসিক বানিয়াচং ও কিংবদন্তি গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে)। পুরোনো
রাজবাড়ি (সাগরদিঘির পশ্চিমপাড়), সাগরদিঘি ও দাড়াগুটির ইতিহাস, বিবির মোকাম, পুরান
ভাগ ও কালিকাপাড়া মসজিদ, গড়ের খাল, সাত লাইড়্যার কাহিনী, বিথলঙ্গের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের
আখড়া, শ্যাম বাউল আমাদের এখনও ঐতিহ্যাশ্রয়ী করে রেখেছে। মৈমনসিংহ গীতিকার অনেক
কাহিনী আবর্তিত হয়েছে বানিয়াচংয়ে। আলাল দুলালের কিচ্ছা, অধুয়া সুন্দরী ও ভবানীর
প্রেমকাহিনী পৃথিবীজুড়ে খ্যাত। এসব নিয়ে আমি বাংলা একাডেমি লোকসংস্কৃতি গ্রন্থে
বিস্তারিত আলোচনা ও মিনি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছি। এসব কাহিনী নিয়ে সরকারিভাবে
ডকুমেন্টারি করা যেতে পারে।
বানিয়াচংয়ে জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য গুণিজন, বারো ভুঁইয়ার অন্যতম
রাজা আনোয়ার খাঁ, বিখ্যাত লেখক মুনসুর বয়াতি, ফৈজু ফকির, শিক্ষক উবেদুল হাসান,
কামরূপ শাসনাবলি গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক পদ্মনাথ সরস্বতী, বাইসাইকেলে
বিশ্বভ্রমণকারী অর্ধশত গ্রন্থের লেখক ও ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, ব্রিটিশবিরোধী
আন্দোলনের অন্যতম নেতা হেমসেন সুশীল সেন, কমরেড আদম আলী, মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড ইন
কমান্ড মেজর জেনারেল এম এ রব, বুদ্ধিজীবী শায়ীদুল হাসান, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠতা
ফজলে হাসান আবেদ, শিল্পী সুবীর নন্দী প্রমুখ। তাদের সম্পদ-সম্পত্তি বেদখল হয়ে
যাচ্ছে। এসব প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় এনে সংরক্ষণ ও পর্যটনকেন্দ্র করা যেতে
পারে। এসব গুণিজনের বিস্তারিত তথ্যচিত্র আমার ‘বানিয়াচংয়ের শতজন’ গ্রন্থে রয়েছে।
সোয়াম্প ফরেস্ট হিসেবে খ্যাত লক্ষ্মী বাঁওড় ইতোমধ্যে পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে এ জলাবনকে দ্রুত পর্যটনের আওতায় নিয়ে এলে
বানিয়াচংবাসী আরও ঐতিহ্যাশ্রয়ী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মহান মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে এ এলাকার গর্বিত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জেনারেল এম এ রব ও শহীদ বুদ্ধিজীবী শায়ীদুল হাসান, মাখালকান্দির গণকবর এবং হলদারপুরের বিমান হামলার এলাকা সংরক্ষণ করলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অম্লান হয়ে থাকবে। বানিয়াচংয়ের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার ‘বানিয়াচংয়ের মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধা’ গ্রন্থে বিস্তারিত তথ্যচিত্র আছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সব কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন- এসব স্থান ও ব্যক্তির বাড়ি পর্যটনের আওতায় নিয়ে এসে সংরক্ষণ করুন।