অপরিকল্পিত নগরায়ন
ড. আদিল মুহাম্মদ খান
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:২১ এএম
২৭ জানুয়ারি বিআইপি
আয়োজিত ‘স্থানীয় পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন : আগামীর চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ
সম্মেলনে নগর পরিকল্পনাবিদরা অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়ের যে আভাস দিয়েছেন
তা উদ্বেগের। রাজধানীসহ বিভাগীয় কিছু শহরে পরিকল্পিতভাবে সামান্য উন্নয়ন হলেও জেলা-উপজেলা
শহরে কিছুই হচ্ছে না, এমনটিই অভিমত তাদের। সেখানে যত্রতত্র শিল্পায়নসহ নানা অবকাঠামো
তৈরি হচ্ছে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পরিকল্পনা করা হলেও তা ইতিবাচক কোনো ফল দিচ্ছে
না, এ অভিযোগও বহুদিনের। প্রতিটি দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার কিছু সুনির্দিষ্ট ধাপ
থাকে। কৃষিনির্ভর উৎপাদনব্যবস্থা থেকে কোনো কোনো দেশের যাত্রা হয় এবং পরে শিল্পের নানা
খাতে দেশটির উৎপাদনব্যবস্থা নির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে। তবে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা যেমনই
হোক, প্রতিটি দেশকেই পরিকল্পিত উন্নয়নের পথ পরিগ্রহ করতে হয়। একই কথা আমাদের ক্ষেত্রেও
প্রযোজ্য।
দুঃখজনক হলেও
সত্য, স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর অতিক্রান্তেও নগর ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা
সন্তোষজনক নয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়কও নয়। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানী ঢাকা কিংবা
চট্টগ্রামের মতো বড় শহরের পরিকল্পনাগত ত্রুটি নিয়ে আমরা আলোচনা করে আসছি। যেহেতু বৈশ্বিক
বিভিন্ন সমীক্ষা কিংবা তালিকায় বাসযোগ্যতার নিরিখে বড় শহরগুলো তলানিতে থাকে, তাই আমাদের
মনোযোগ বড় শহরগুলোয় থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জেলা ও মফস্বল শহরগুলোর
বাসযোগ্যতা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ এলাকায় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শিল্পকারখানা
তৈরি হচ্ছে। গ্রামীণ বসতভিটার পাশে অপরিকল্পিত শিল্পকারখানা কিংবা খোলা ইটভাটা তৈরি
হচ্ছে যা গ্রামীণ পরিবেশ বিনষ্ট করছে। গ্রামীণ অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার বিরূপ
প্রভাব বহুমুখী। কারণ শিল্পকারখানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি থাকায় জলাশয়, হাওর-বাঁওড়
ও নদ-নদী ধ্বংস হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন কার্যক্রমের পথ সুগম করার লক্ষ্যে
জলাশয় ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে জলাশয় হারাচ্ছে গতিশীলতা ও প্রাণ। সার্বিকভাবে
সারা দেশে ভৌত ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ভুল পথে চালিত হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান।
বিশ্বের প্রায়
অধিকাংশ আধুনিকায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত হয়েছে। কিন্তু
উদাহরণযোগ্য দেশগুলোর বিপরীতে আমরা যে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে পড়ছি তার অন্যতম
কারণ পরিকল্পনাজনিত ত্রুটি ও দূরদর্শিতার অভাব। বিশেষত সার্বিকভাবে যে বিশেষ পরিকল্পনা
করার কথা তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। যতটুকু নীতিমালা রয়েছে
তার প্রতিপালন এবং অনুসরণে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের অনীহা রয়েছে। সার্বিকভাবে
যে উন্নয়ন কার্যক্রম হচ্ছে তা নগর-গ্রামীণ অঞ্চলের জন্য অদূর মেয়াদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি
করতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেকের। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা
রয়েছে আমাদের। আমরা যদি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাই তাহলে পরিকল্পনার অনুশীলন জরুরি।
কিছু মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে পুরো দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি, বড় শহরগুলোর
জন্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা হয়েছিল। এসব কর্তৃপক্ষ বহু পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেও
বাস্তবায়নের হার ২০ শতাংশেরও কম। শুধু রাজশাহী শহরে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েছে বেশি
এবং পরিকল্পনার অনুশীলন বেশি হওয়ায় শহরটিতে দৃশ্যমান পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। রাজশাহীর
এ পরিবর্তন ব্যতিক্রম। রাজশাহীতে এমনটি সম্ভব হয়েছে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সব পক্ষের
সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে।
ভৌত উন্নয়নের
ক্ষেত্রে সরকার এখন দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। মসজিদ পরিকল্পনা ও জলাশয় সংরক্ষণ। কিন্তু
সারা দেশে স্থানিক ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে পরিকল্পনার গাইডলাইন নেই। জাতীয় নীতিমালা
ও দিকনির্দেশনা না থাকলে উপরোক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্থানিক অবকাঠামো উন্নয়ন
কাঙ্ক্ষিত সুফল দেবে না। শুধু ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল প্ল্যান পর্যাপ্ত নয়। প্রয়োজন আঞ্চলিক,
বিভাগীয়, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদভিত্তিক পরিকল্পনা যার সঙ্গে ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল প্ল্যানের
সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের ক্রিটিক্যাল পরিকল্পনা এভাবে বিভিন্ন স্থানীয়
পর্যায়ের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নিয়ে আসা গেলে গ্রামীণ অবকাঠামোর
ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে। কোন এলাকায় কী ধরনের উন্নয়ন হবে, তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে
হবে। এজন্য সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে।
যেখান থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নয়নের জন্য অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক থাকবে। একই সঙ্গে
জাতীয় পরিকল্পনা কাঠামো, আঞ্চলিক পরিকল্পনা এবং স্থানিক পরিকল্পনা থাকা জরুরি। দুঃখজনক
হলেও সত্য, আমাদের ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল পরিকল্পনা নেই। সঙ্গত কারণেই বিভাগীয়, জেলা,
উপজেলা পর্যায়ের জন্যও সমন্বিত ধাপের পরিকল্পনার অভাব।
সম্প্রতি উপজেলা
পর্যায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হচ্ছে। উপজেলা মাস্টারপ্ল্যানে হঠাৎ জোর দেওয়ার
ফলে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা
নেই। এ কথা সত্য, কাঠামোর ওপরের স্তরে পরে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হতে পারে। কিন্তু
তখন এ আলাদা স্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়গত ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা দিতে পারে। বাড়তে পারে উন্নয়ন
ব্যয় এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিভাগীয়,
জেলা ও উপজেলা স্তরে যেসব অনুষঙ্গ অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে তৈরি হওয়ার কথা, সেগুলো
একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সুফল দেবে না। উপজেলা মাস্টারপ্ল্যান
বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এর ওপরের স্তরের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নেও
জোর দেওয়া জরুরি। স্মরণে আছে, সরকার দেশব্যাপী গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে ‘আমার গ্রাম
আমার শহর’ প্রকল্প পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ১৫টি উপজেলা নির্বাচন করেছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ওপরের স্তরের
কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয়মূলক পরিকল্পনা আছে কি না। এখনও এমন কোনো পরিকল্পনার কথা আমরা
জানতে পারিনি। ফলে এ প্রকল্পের ইতিবাচক প্রভাব কতটা দৃশ্যমান হবে তা-ও বড় প্রশ্ন বটে।
দেশে ভৌত অবকাঠামো
উন্নয়নের পরিকল্পনা সচরাচর স্থানীয় সরকারের প্রকৌশল বিভাগ করে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে
প্রকৌশল সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নেওয়া হয়। অধিকাংশ প্রকৌশল সংস্থার পরিকল্পনা সম্পর্কে
বিশদ জ্ঞান ও দূরদর্শিতার অভাব থাকে। এসব পরিকল্পনা স্থানীয় পর্যায়ের পরিকল্পনা বিভাগের
মাধ্যমে করালে প্রথম সমস্যা হলো, যারা এখানে কাজ করেন তারা অবকাঠামো উন্নয়নের কথাই
ভাবেন। কিন্তু পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মাণের স্থান, পারিপার্শ্বিক অবস্থা
এবং পরিবেশের সঙ্গে যোগসূত্রতা খুঁজে বের করাসহ আনুষঙ্গিক আরও বিষয় থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে
একটি প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট কিংবা স্পেশাল প্ল্যানিং অধিদপ্তর থাকলে প্রকৌশল সংস্থার
ঘাটতি পূরণ করা দুরূহ হতো না। পরিকল্পনা বিভাগ থাকলে তারা সবকিছু বিবেচনা করে পরিকল্পনা
প্রণয়ন করতে পারত। তার ভিত্তিতে প্রকৌশল বিভাগ অবকাঠামো নির্মাণ করলে উন্নয়ন টেকসই
হতো। স্বাধীনতার বায়ান্ন বছর অতিক্রান্তে পরিকল্পনা প্রণয়নের বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান
গড়ে তোলা যায়নি। ফলে সারা দেশে পরিকল্পনার অনুশীলনের ঘাটতি বেড়ে চলেছে। পরিকল্পনা প্রণয়নে
বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান কেন অত্যন্ত জরুরি তা অনেকেরই না বোঝার কথা নয়। উন্নয়ন মানে তো
শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নই নয়, সামগ্রিক অর্থে এর ব্যাপকতার ব্যাপারেও নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ
নিষ্প্রয়োজন।
মূল সংকট প্ল্যানিং ফ্রেমওয়ার্ক না থাকা। প্ল্যানিং ফ্রেমওয়ার্ক না থাকলে অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়বে কিন্তু কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ সুনামগঞ্জে হাওরের ওপর মাল্টিপারপাস সড়ক নির্মাণ। শুরুতে এ প্রকল্পের সুবিধার কথা বলা হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের পর বলা হলো এটি আমাদের পরিবেশের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরে বলা হলো, হাওর এলাকায় সড়ক নির্মাণ করতে হলে এলিভেটেড সড়ক নির্মাণ করতে হবে। পরিকল্পনার ঘাটতি নিয়ে চিন্তা ও পরিকল্পনা প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের যে ঘাটতি রয়েছে তা দূর করার কথা ভাবতে হবে। যদি তা না করা যায়, তাহলে প্রকৃতিত অর্থাৎ পরিবেশ-প্রতিবেশও হুমকির মুখে পড়বে। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রেখে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন দুরূহ। কাজেই এ ব্যাপারে মনোযোগ না বাড়িয়ে ও যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা থাকবেই।