× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ভাষার মাস

মাতৃভাষার চর্চায় যা করতে হবে

ড. মোহীত উল আলম

প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:১৯ এএম

ড. মোহীত উল আলম

ড. মোহীত উল আলম

সকালে এক বন্ধু একটি ভিডিও পাঠাল মেসেঞ্জারে। খুলে দেখলাম রাধারমণ দত্তের বিখ্যাত গান ‘ভ্রমর কইও গিয়া’র একটি চমৎকার সংস্করণ। তাজিকিস্তানের ভাষায় গাইছে সে দেশেরই এক তরুণী শিল্পী নোজিয়া কারামাতুল্লাহ। আমি এ লেখাটা লিখছি ৩০ জানুয়ারির সকালে। এক দিন পরই অমর ভাষার মাস শুরু। তখন দেখলাম বাংলা সংস্কৃতি তো বিশ্বের বহু দেশে পরিচিত হয়ে উঠেছে, যেমন তাজিকিস্তানে। অমর একুশের বিরাট অবদান এখানে যে, একটি অঞ্চলভিত্তিক ভাষার বিশ্বপর্যটন চলছে। একটি অঞ্চলভিত্তিক সংস্কৃতিরও বিশ্বপর্যটন চলছে।

পাঠকের মনে একটি প্রশ্ন উদিত হতে পারে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তার হিসেবে নোজিয়া কারামাতুল্লাহর যে উদাহরণ দিলাম, তাতে তো ভাষার তরজমাকৃত রূপই পেলাম, মূল ভাষাটা তো পেলাম না। অর্থাৎ তরুণী তো গানটি কাজাখস্তানের ভাষায়ই গেয়েছেন, মূল বাংলা ভাষায় তো গাননি। কারণ ইদানীং ফেসবুক আর মেসেঞ্জারে অনেক ভিডিও পাচ্ছি, যেখানে বিদেশি শিল্পীরা নিজেদের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের অনেক গান বাংলা ভাষায় পরিবেশন করছে স্বচ্ছন্দে। সেদিক থেকে তো নোজিয়ার উদাহরণ এক ধাপ পেছনে। আমার উত্তরটা আসবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে।


আমরা ১৯৫২ সালের ফেব্রয়ারিতে ভাষার অধিকারের আন্দোলনটা তুঙ্গে নিয়ে যাই বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অধিষ্ঠিত করার জন্য। সালাম, রফিক, বরকত, শফিকরা পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর, শুধু শহীদ হননি; বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী মর্যাদা নিয়ে এসেছেন আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বায়ান্নর আন্দোলনটা ব্যাপকভাবে উর্দু ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছিল ইংরেজির বিরুদ্ধে। কারণ জিন্নাহ গুরুতর বাস্তবতা অস্বীকার করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানের দুটি ব্যাপক বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত প্রদেশের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও ভাষাগত সংযুক্ততা রক্ষায় তিনি এ প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। কিন্তু এটি ছিল একটি তাত্ত্বিক চিন্তা, যার বাস্তব অনুসরণের জন্য প্রেক্ষাপট সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। কারণ কিছুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ী ও তাদের দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র ছাড়া তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনপদে কোনোকালেই উর্দু ভাষার ব্যবহার ছিল না। কিন্তু সদ্যবিদায়ি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভাষা ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহার তখনও ছিল এবং এ স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ বছর বয়সেও বলা যাবে না যে ইংরেজির ব্যবহার কমে গেছে বা বাংলা ভাষার দ্বারা এর ব্যবহার প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

ফলে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন মূলত জিন্নাহ-ঘোষিত উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা নিয়ে পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও, উর্দু ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের অনুপস্থিতি এবং ইংরেজির ব্যাপক উপস্থিতির কারণে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়। এবং এ রীতি চলতে থাকলে অর্থাৎ প্রতি বছর অমর একুশে পালনের প্রাক্কালে ও সময়ে যে বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তা হলো ইংরেজি সাইনবোর্ড নামিয়ে দিয়ে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া। বস্তুত পাকিস্তানের শেষের দিকে আমরা যখন কৈশোর পার করছি, তখনও বিপুল উৎসাহে আমরা যে কাজটি করতাম তা হলো প্রচুর ক্ষোভ নিয়ে ইংরেজি ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ড, ব্যানার, নামফলক উপড়ে নেওয়া। বায়ান্নর পর পাকিস্তান এখানে আরও ১৯ বছর টিকে ছিল এবং ওই সময়ে আমরা মাতৃভাষা বাংলা সর্বস্তরে চালুর প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে মূলত ইংরেজি ভাষার ব্যবহারের বিরুদ্ধে কামান দাগতাম।

এই যে ‘সর্বস্তরে চালু’ কথাটা বললাম, এটাই আসলে আমার আজকের আলোচনার মূল বিষয়। অত্যন্ত হা-হুতাশ করে বলতে হয়, বাংলা ভাষা এত যুগ পরও সর্বস্তরে চালু হতে পারেনি। আমি বছর কয়েক আগে অনুরূপ একটা লেখায় বাংলা ভাষা কেন সর্বস্তরে এযাবৎ চালু হতে পারেনি ব্যাখ্যায় ফরাসি দার্শনিক এবং ইতিহাসবিদ আর্নেস্ট রেনানের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ওয়াট ইজ আ নেইশন?’-এর (১৮৮২) বক্তব্যের অনুসরণে বলেছিলাম, একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনে ভাষা, ধর্ম, ভূগোল, ইতিহাস কিছুই মৌলিক উপাদান হিসেবে কাজ করে না। ভাষার ক্ষেত্রে বলেছিলাম, মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের যোগাযোগের ভাষা এক আরবি হলেও তাতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপস্থিতি দেখা যায়। ধর্মের ক্ষেত্রেও মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারত, নেপাল কিংবা চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ইত্যাদি দেশের উল্লেখ করে বলেছিলাম ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধ যা-ই হোক না কেন, ধর্ম এক হলেও কিন্তু দেশ ভিন্ন। এদিক থেকে পাকিস্তান ছিল বড় একটা উদাহরণ।

দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হবে, কিন্তু বাংলাদেশ জন্ম লাভ করার পর ওই তত্ত্বের অসারতা প্রমাণিত হয়। সেরকম ভূগোল বা ইতিহাসও। ভারতবর্ষ বহু বছর ধরে একই ভূগোল এবং একই ইতিহাস শেয়ার করছে, কিন্তু রাষ্ট্র জন্মাল একাধিক। ভারতবর্ষ বা বৃহত্তর রাশিয়া আরেকটি দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এ দুটি দেশের মধ্যে অভ্যন্তরস্থ বহুজাতিক এবং বহু জাতীয় স্তরের ভাষা বিদ্যমান, কিন্তু দেশ একটিই। ভারতের জাতীয় ভাষাগুলো যেমন বাংলা, পাঞ্জাবি, উর্দু, হিন্দি, মারাঠি ইত্যাদির মধ্যে কোনো ভাষা সাহিত্যে এবং ব্যাপকতর দিক থেকে একটি আরেকটির চেয়ে কম নয়, কিন্তু ভারত টিকে আছে একটি দেশ হিসেবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে রেনানের ব্যাখ্যাটা নেওয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, একটি দেশ বা তার ভাষায় ‘ন্যাশনালাইট’, ইংরেজিতে ‘নেইশানহুড’, টিকে থাকে একটি বৃহত্তর সম্মতি বা কনসেন্টের ওপর ভিত্তি করে। যেমন আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি সবই বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেয়ে আলাদা, কিন্তু তারা এ মানসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা বাংলাদেশের অন্তর্গত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয়তা বরণ করে টিকে থাকবে।

এ ‘সম্মতি’র আলোকে বলতে হয়, একটি দেশের ভাষা বা একটি জাতির ভাষা সে দেশের অস্তিত্বের জন্য কোনো আবশ্যকীয় উপাদান নয়। কথাটা শুনলে খারাপ লাগলেও সত্যটা হলো, সর্বস্তরে একটি মাতৃভাষা পুরোপুরি চালু হবে এ কথাটা যতট না সত্য তার চেয়ে বেশি মিথ। যদিও আমরা বলতে পারি, পশ্চিমা এককালীন সাম্রাজ্যিক, প্রশাসনিক ও কিছুটা সামাজিক ভাষা ইংরেজি বাংলা ভাষা সর্বস্তরে চালুর ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়, কিংবা উত্তরাধুনিক যুগে ধর্মীয় চেতনার বিশ্বব্যাপী নতুনভাবে উদ্বোধনের পর আরবি ভাষাও মোটামুটিভাবে মুসলমান জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে ব্যাপকভাবে চর্চিত হওয়ার উপলক্ষ তৈরি হয়েছে, এবং কোথাও কোথাও এ ভাষা ব্যবহারের মধ্যে সামান্যতম হলেও মৌলবাদী চেতনার বিকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে। কেননা যেখানে আগে শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় সুন্দর বাংলা শব্দ প্রয়োগ করে আমরা যোগাযোগ স্থাপন করতাম, সে জায়গায় অনাবশ্যকভাবে বহু বিজাতীয় শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা সব স্তরে লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে।

তাই বলে কি বাংলা ভাষা ব্যবহারের পরিমাণ বা মাত্রা কমে যাবে? ধরুন হিমালয় পর্বতের চূড়াগুলোয় বরফ গলা শুরু হয়েছে। তাই বলে কি এ পর্বতগুলো মানবসমাজের দৃশ্যমান জীবিতকালে গলতে গলতে পামির মালভূমি হয়ে যাবে? বা আরেক দিক থেকে বলি, আমরা কি রবীন্দ্রনাথকে কখনও কিয়দংশও ব্যবহার না করে পারব? যা আমাদের চেতনায় আনতে হবে তা হলো প্রযুক্তিগত যুগে বাংলা ভাষার ‘সর্বস্তরে চালু’র বাসনা বাদ দিয়ে বাংলা ভাষাকে সর্বভুক একটি ভাষায় পরিণত করতে হবে। ইংরেজি যেমন পৃথিবীর বহু ভাষা আত্মস্থ করে নিজের পরিক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করছে, তেমন বাংলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রেও এ-জাতীয় প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনার জায়গা দিয়ে কৌলীন্যপ্রথা সর্বত পরিত্যাগ করে একেবারে তাৎক্ষণিক এবং সার্বক্ষণিক প্রয়োজন মেটায় সে রকমের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তৈরি করতে হবে। শুধু যে বিদেশি ভাষা এবং প্রকরণ অকাতরে গৃহীত হবে তা নয়, আঞ্চলিক ভাষাও যে একটি জাতীয় ভাষাকে সমানে পরিপুষ্ট করতে পারে তারও হাজার হাজার নজির আমাদের ভাষায়ই বিদ্যমান।

রাষ্ট্র চলে একটি জঙ্গম পন্থায় এবং সে জায়গায় রাষ্ট্রের ভাষার মধ্যেও জঙ্গমতা বা চলিষ্ণুতা থাকতে হবে সর্বোচ্চ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন বা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দিয়ে থাকেন, সেদিক থেকে বাংলা ভাষার মর্যাদা বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থানে সংরক্ষিত, কিংবা অমর একুশে যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে, সেটিও আমাদের বিরাট প্রাপ্তি। এগুলো পাথেয় করে আমরা ঐতিহাসিক চেতনায় ঋদ্ধ হতে পারি। কিন্তু যে কথাটি বলতে চেয়েছি, তা হলো কোনোরকমের আত্মশ্লাঘায় না ভুগে স্পেডকে স্পেড বলাই ভালো।

প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলা, ইংরেজি কিংবা আরবি কোনটিতে কেমনভাবে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষিত হচ্ছে তা আমার জানা নেই, কিন্তু এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি, বাংলাদেশ যেহেতু সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে, সেজন্য নিচের দিকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ভাষা শিক্ষার সহজ, আধুনিক ও প্রায়োগিক দিকসমূহ সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষকসমাজকে তৈরি করা হবে, কিংবা হচ্ছে। মোক্ষম পথ তা-ই। আগেই বলেছি বাংলা ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে করণীয় কি। সেই কাজগুলো হোক আর সময়ক্ষেপণ না করে

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা