× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সুন্দরবন

অপরিণামদর্শিতার দৃশ্যমান ক্ষত

শেখ ইউসুফ হারুন

প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:০৫ এএম

আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:৩৭ পিএম

শেখ ইউসুফ হারুন

শেখ ইউসুফ হারুন

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, বন বিভাগের কর্মচারীদের সহায়তায় সুন্দরবনে বিষপ্রয়োগে মাছ শিকারের প্রবণতা বেড়েছে। সুন্দরবন মাছশূন্য হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জালের মতো প্রবাহিত হয়েছে অসংখ্য খাল; যাকে স্থানীয় ভাষায় খাঁড়ি বলে। এ খাল বা খাঁড়ি জোয়ারের সময় পানিতে ভরে যায়। আবার ভাটিতে পানি নেমে গেলে খালের তলদেশ উন্মুক্ত হয়। জোয়ারের পানির সঙ্গে খাবারের অন্বেষণে বিভিন্ন প্রকার মাছ খালের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ভাটার সময় পানি নেমে গেলে মাছ জেলেদের জালে আটকা পড়ে। যে জাল দিয়ে এভাবে মাছ ধরা হয় তাকে পাটাজাল বলে। সাধারণত জেলেরা বন বিভাগ থেকে মাছ ধরার পারমিট নিয়ে জোয়ারের সময় খালের ওপরের দিকে পাটাজাল পেতে রাখে। কিন্তু কিছু লোভী জেলে বেশি মাছ ধরার মানসে খালের প্রবেশমুখে এমন জায়গায় পাটাজাল পাতে যেখানে ভাটির সময় পানি সম্পূর্ণ নামে না। পরে তারা পানিতে বিষ প্রয়োগ করে মাছগুলো ধরে ফেলে। স্থানীয়রা বিষপ্রয়োগকে ‘পানি পড়া’ বলে। বিষপ্রয়োগের ফলে ছোট ছোট মাছের পোনা ও রেণু থেকে শুরু করে যত প্রকার জলজপ্রাণী বা উদ্ভিদ থাকে তা সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যে প্রকার বিষই প্রয়োগ করা হোক, তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর।

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় গঠিত ব-দ্বীপের সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হলো সমুদ্রোপকূলবর্তী বন, যেখানে জোয়ারে পানি ওঠে আর ভাটায় নেমে যায়। এ বনভূমির বৈশিষ্ট্য হলো, পানিতে যখন গাছ ডুবে যায় তখন শ্বাসমূলের মাধ্যমে গাছ শ্বাস গ্রহণ করে এবং এদের বীজ গাছ থেকে পড়ার আগেই ফলের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়ে থাকে। মাটিতে পড়লেই সরাসরি মাটিতে গেঁথে মূল বিস্তার করতে পারে। ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ৫১৭ বর্গকিলোমিটার (৬৬%) রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ (৩৪%) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। দক্ষিণাঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সুন্দরবনের অবদান অসামান্য। সুন্দরবনে প্রায় ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। তা ছাড়া ৩৫ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পাওয়া যায়। সুন্দরবনে অনেক প্রাণী আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। সুন্দরবন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকিয়ে দিয়ে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।

আশঙ্কা রয়েছে, মানুষ্যসৃষ্ট অপরিনামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলে একসময় সুন্দরবন হয়ে পড়বে পশুপাখিবিবর্জিত এক বিরানভূমি। এমনিতেই ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে সুন্দরবনে লবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরী ও পশুর গাছ মরে যাচ্ছে প্রতিদিন। তার ওপর গাছ চুরি তো আছেই। বনদস্যু ও বন বিভাগের কিছু অসৎ কর্মচারী মিলেমিশে সব বড় গাছ চুরি করে গোপনে পাচার করে দিচ্ছে। বাইরে থেকে সুন্দরবনকে পুষ্পপল্লবে সুশোভিত দেখা গেলেও ভেতরে গাছশূন্য। শুধু মাছ ও গাছ নিধন নয়, আমাদের শৌর্যবীর্যের প্রতীক ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ সুন্দরবন থেকে বিলীন হতে চলেছে। ২০১৮ সালের বাঘ গণনা অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১৪; যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। হরিণের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। হরিণকে মরতে হচ্ছে তার মাংসের জন্য আর বাঘকে মরতে হচ্ছে তার চামড়ার জন্য। একসময় সুন্দরবনে এক শিংগা গন্ডার ছিল। বিলুপ্তের তালিকায় আরও অনেক প্রাণী রয়েছে। একশ্রেণির মানুষের লোভের শিকার সুন্দরবনের জীবজন্তু। এদের নিবৃত্ত করা প্রয়োজন। তা না হলে সুন্দরবন কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে একদিন।

সুন্দরবনের ওপর প্রায় ৩০ লাখ লোক কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। প্রতিদিন মাছ ধরা, লাকড়ি ও মধু সংগ্রহ করতে প্রচুর লোক সুন্দরবনে প্রবেশ করে। কেউ কেউ বন বিভাগ থেকে পারমিট নিয়ে সংরক্ষিত বনে প্রবেশ করে। পারমিট ছাড়া অবৈধভাবে প্রচুর বাওয়ালি, জেলে, মৌয়াল সুন্দরবনে প্রবেশ করে। বন আইন, ১৯২৭ অনুযায়ী বিনা অনুমতিতে সংরক্ষিত বনে অনুপ্রবেশ দণ্ডনীয় অপরাধ। বন বিভাগের অলক্ষে তারা এটি করে থাকে। বিশাল বন পাহারা দেওয়ার জন্য বন বিভাগের লোকবলের অভাব রয়েছে। এমনকি তাদের যে অস্ত্র দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে রয়েছে। বিষপ্রয়োগে মাছ ধরা বন আইন, ১৯২৭-এর ২৬(১এ) এফ ধারার বিধান মোতাবেক দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধের জন্য সর্বনিম্ন ছয় মাস এবং সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার শাস্তি রয়েছে। কিন্তু বিষের প্রকৃতি নির্ণয়ের কোনো যন্ত্রপাতি বন বিভাগের না থাকায় আদালতে মামলাগুলো প্রমাণ করা যাচ্ছে না।

যারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুন্দরবনের নদীতে বিষপ্রয়োগে মাছ ধরছে তারা সীমা লঙ্ঘনকারী। তাদের প্রতি কোনো কৃপা বা অনুকম্পা দেখানো উচিত হবে না। কঠোরভাবে এদের প্রতি আইন প্রয়োগ হওয়া উচিত। প্রয়োজনে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে বিষপ্রয়োগকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে নতুন আইন করা যেতে পারে। যারা আইন প্রয়োগ করবেন তাদেরও আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। তা না হলে সুন্দরবন একসময় মাছশূন্য হবে এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। সুন্দরবন আমাদের সম্পদ ও সম্পত্তি। সুন্দরবন রক্ষার দায় শুধু সরকারের একার নয়, কমবেশি সবারই। আমাদের সুরক্ষা প্রাচীর সুন্দরবনের ওপর মনুষ্যসৃষ্ট অভিঘাত ঠেকাতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ছাড়া গত্যন্তর নেই। সুন্দরবন ও জীববৈচিত্র রক্ষার দায় কারোর ভুলে যাওয়া সমীচীন নয়। 

  • নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা