সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪৪ এএম
মানুষ কেন আত্মঘাতী হয়ে ওঠে এ প্রশ্নের জবাব যদি আমরা আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট কিংবা পরিপার্শ্ব বিবেচনায় খুঁজি তাহলে মোটাদাগে যে বিষয়গুলো সামনে উঠে আসে, তা হচ্ছে- হতাশা, সাধ্যের বাইরে সাধ, সামাজিক-পারিবারিক ক্ষেত্রে বিরাজমান কলহ-বিবাদ, নানা অসংগতিসহ বহুবিধ নেতিবাচক কারণ। কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও বলা যায়, একজন আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষ সংবিৎ ফিরে পেয়ে নিজেকে রক্ষার পথও নিজেই খুঁজে নিতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের স্মরণে আসে, জনপ্রিয় আরবি উপকথার হতদরিদ্র সেই কাঠুরিয়ার কথা, যে বনে গিয়ে কাঠ কাটত এবং কর্তন করা কাঠের বোঝা একই সঙ্গে পারিবারিক নানা ঝঞ্ঝা যাকে করে তুলেছিল আত্মহত্যাপ্রবণ। ওই কাঠুরিয়ার মনে হতো দুর্বহ জীবন টেনে চলার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। সে বনে কাঠ কাটতে গিয়ে প্রায়ই চিৎকার দিয়ে বলতÑ আজরাইল, তুমি কোথায়? আমার মতো দুর্বহ জীবন কি তোমার চোখে পড়ে না? তুমি কি আমাকে তুলে নিতে পারো না? একদিন আজরাইল তার সামনে দাঁড়াল। প্রশ্ন করল, ডাকাডাকি করছিস কেন? কাঠুরিয়া কেঁপে উঠল। বলল, কর্তিত কাঠের বোঝা আমি বয়ে নিতে পারছিলাম না, তাই তোমাকে ডাকছিলাম। আজরাইল পাল্টা প্রশ্ন করল, তাহলে কি তোকে তুলে নেওয়ার আর্তনাদ হারিয়ে গেল? ওই কাঠুরিয়া তখন বেঁচে থাকার উপযোগিতা নতুন করে উপলব্ধি করল।
সম্পাদকীয় স্তম্ভে
এই গৌড়চন্দ্রিকার কারণ ২৮ জানুয়ারি বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের একটি জরিপ প্রতিবেদনের
বরাত দিয়ে, ‘এক বছরে ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, নারী বেশি’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি।
আঁচল ফাউন্ডেশন ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ২০২৩ সালে সারা
দেশের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে এবং এর মধ্যে
নারীর সংখ্যাই বেশি। আরও উদ্বেগজনক তথ্য তাদের গবেষণা জরিপে উঠে এসেছে। তা হলো, শিক্ষার
স্তর বিবেচনায় আত্মহত্যায় স্কুলগামীদের সংখ্যাই বেশি। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট
বিশ্লেষণ করলে অস্বস্তিদায়ক অনেক চিত্রই দৃশ্যমান হয়। আত্মহত্যার প্রবণতা যে শুধু শিক্ষার্থী
পর্যায়েই দৃশ্যমান তা-ও নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষেরই আত্মহত্যার খবর সংবাদমাধ্যমে
প্রায়ই উঠে আসছে। অস্ট্রীয় মানসিক রোগ চিকিৎসক, মনস্তাত্ত্বিক এবং মনোচিকিৎসার উদ্ভাবক
সিগমন্ড ফ্রয়েড আত্মহত্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মৃত্যুতৃষ্ণার বিষয়টি নানাভাবে
বিশ্লেষণ করেছেন। তার ব্যাখ্যাতেই জানা যায়, সব আত্মহত্যার ধরন এক ছকে ফেলা ভুল ও বিপজ্জনক।
১৯৩৯ সালে ফ্রয়েড পরলোকগমন করেন। কিন্তু তার তত্ত্বীয় বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপট বর্তমান
তো বটেই ভবিষ্যতের জন্যও নিশ্চয় গুরুত্ববহ হয়ে থাকবে। মৃত্যুতৃষ্ণার বিষয়গুলো ফ্রয়েড
যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এ বাস্তবতায় সামনে আসে একজন সাধারণ মানুষের আত্মঘাতীপ্রবণ হওয়া
এবং একজন উগ্রবাদী কিংবা যেকোনো হন্তারকের অন্যের সর্বনাশ ঘটিয়ে নিজেকে নিঃশেষ করে
ফেলার সংকল্প। নিশ্চয়ই এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর।
একজন উগ্রবাদী
কিংবা হন্তারকের নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মধ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলেও, একজন সাধারণ
মানুষের আত্মঘাতীপ্রবণ হয়ে ওঠার পেছনে প্রায় সব অনুষঙ্গই সৃষ্ট মুখ্যত হতাশাজনিত কারণ
থেকে। একজন শিক্ষার্থী রাষ্ট্র ও সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। এই ভবিষ্যৎ কর্ণধারদের কেউ
কেউ যখন নানা সামাজিক ও পারিবারিক কারণের প্রেক্ষাপটে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে আত্মহত্যার
পথ বেছে নেয় এর দায় সমাজ এবং পরিবার কোনো পক্ষেরই এড়ানোর অবকাশ থাকে না। আমরা জানি,
বয়ঃসন্ধিকালে এবং এর পরবর্তী ধাপে যে কারোর মধ্যে অধিকতর আবেগতাড়িত হওয়ার প্রবণতাগুলো
যেমন জাগতে থাকে তেমনি তাদের প্রত্যাশার খতিয়ানও হতে থাকে বিস্তৃত। কিন্তু সাধ এবং
সাধ্য কিংবা সংগতি বা অসংগতির মধ্যে ব্যবধান যখন বাড়তে থাকে তখন এ অপপ্রবণতা অনেকের
মনোজগৎ অবচেতন করে ঠেলে দেয় অন্ধকারে। এমতাবস্থায় পারিবারিক, সামাজিক ও শিক্ষাঙ্গনের
মতো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে জীবনের সর্বনাশা পথ রুদ্ধ করতে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব
দেওয়াও জরুরি।
আমরা আরও মনে
করি, মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহায়তায় বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে
আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে নির্দিষ্ট সময় বিরতি দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি
তাদের উপযুক্ত পরামর্শ দেওয়া এবং সম্পর্কের ভিত মজবুত করায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন
করা এবং আবেগীয় অনুভূতির নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানোর ব্যাপারেও গুরুত্ব
দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এর পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে মননশীলতার চর্চা বাড়ানোসহ
পরমতসহিষ্ণুতায়ও সমগুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, সমাজের বিভিন্ন কাঠামোর
প্রতিনিধিদের মনেযোগ রাখা উচিত যাতে কোনোভাবেই কারও দায়িত্বহীনতা কিংবা অপরিণামদর্শিতায়
এমন কোনো উপসর্গের সৃষ্টি এবং ব্যাপ্তি না ঘটে যা জীবন, পরিবার তথা সমাজে অনিশ্চয়তা-হতাশার
ছায়া বিস্তৃত করে।
মানসিক স্বাস্থ্য
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা মানুষের উপলব্ধিতে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার ওপরও আমরা
গুরুত্ব দিই। একই সঙ্গে প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধসহ এমন কোনো বিষয়ের প্রতি জীবনতৃষ্ণার
পিপাসা মিটাতে কেউ যাতে ঝুঁকে না পড়ে সেদিকেও নজর গভীর করতে হবে। অথই পানিতে পড়া মানুষ
ভাসমান কিছু ধরে বাঁচার অবলম্বন খোঁজে। পারস্য জনপ্রিয় উপকথায় আছে, কোনো এক জেলে সিংহ
কিংবা অজগরের গ্রাসে পড়ার পর তাদের পেটে ঢুকতে ঢুকতেও বাঁচার অবলম্বন খোঁজেও। রবিনসন
ক্রুসো কিংবা ক্যাস ওয়েলের চলচ্চিত্র কাহিনিসহ অসংখ্য গল্প রয়েছে জীবনতৃষ্ণার নানা
প্রতিচ্ছায়া। জীবনে বিতৃষ্ণা কীভাবে জন্মে এ-ও জানা যায়। এই প্রেক্ষাপট বিশ্রেষণ করে,
মানুষের আশ্রয় ও অবলম্বনের ক্ষেত্রগুলো একই সঙ্গে মানসিক বিকাশ ও সামাজিক-পারিবারিক
ক্ষেত্রে পরিবেশ-পরিস্থিতি সুসংহত করায় দায়িত্বশীল সবাইকে মনোযোগী হওয়া দরকার বলেও
আমরা মনে করি, যাতে জীবনতৃষ্ণা বাড়ে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, এই বোধ মানুষের মনে
প্রথিত করতে হবে। জীবনে সমস্যা থাকবে কিন্তু এর সমাধানে আত্মহত্যা অবলম্বন হতে পারে
না। আত্মহত্যা রোধে সচেতনতার পাশাপাশি এই বোধও প্রথিত করতে হবে কোনো এক বিষয়ে ব্যর্থ
হওয়া মানে পুরো জীবন ব্যর্থ নয়। মানুষের মনের অসুখের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সুখের
বাতাবরণ সৃষ্টির দায়িত্ব কমবেশি সবারই রয়েছে।