বিএনপির আন্দোলন
মহিউদ্দিন খান মোহন
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১০:৪০ এএম
মহিউদ্দিন খান মোহন
ভারতীর টিভি চ্যানেল
‘সনি আট’-এ প্রতি শনি ও রবিবার সকালে একটি কার্টুন সিরিজ প্রচারিত হয় ‘গুল্টেমামা’
নামে। সিরিজটি বড়ই উপভোগ্য। বাচ্চাদের অত্যন্ত প্রিয়। গলদপুর নামে এক গ্রামের ছেলে
‘গুল্টে’। কয়েকজন শিষ্য-সাগরেদ তাকে ঘিরে থাকে সারাক্ষণ। ওরা সবাই তাকে গুল্টেমামা
সম্বোধন করে। গুল্টেমামা নিজেকে সবজান্তা এবং সব কাজের কাজি মনে করে এবং তা জাহির করারও
প্রয়াস পায়। সে ভাব দেখায় এমন কোনো কাজ নেই যা সে করতে পারে না। পৃথিবীতে এমন কিছু
নেই যা সে জানে না। তার সবচেয়ে বড় গুণ গুল মারা। এ গুলবাজি করতে গিয়ে সে প্রতিবারই
ধরা খায় মানুষের কাছে। নিজের যোগ্যতা যখন প্রমাণ করতে যায়, তখনই তার জারিজুরি ফাঁস
হয়ে যায়। কখনও মহল্লা বা অন্য পাড়ার ছেলেদের ধোলাই খেয়ে হাত-পা ভেঙে হাসপাতালের
বেডে শুয়ে থাকে। কখনও পুলিশে ধরা পড়ে মেহমান হয় হাজতখানার। তাতে কী? গুল্টেমামার
গুলবাজির বিরাম নেই। নিত্যনতুন আইডিয়া আবিষ্কার চলতেই থাকে।
এমন গুল্টেমামার
মতো গুলবাজের কমতি নেই আমাদের সমাজে। এরা চাপার জোরে শুধু বিশ্ব নয়, পারলে সৌরজগৎ জয়
করে ফেলে। মুখে তারা বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার, কাজে ফেল্টু মিয়া। গুলবাজিতে এরা এতটাই
পারদর্শী যে, অনেক সময় এদের হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলসের পৌত্র-দৌহিত্র বলে ভ্রম
হয়। কখনও কখনও তো মনে হয় ‘মহামান্য গোয়েবলস’ বোধ করি ধরাধামে পুনরাগমন করেছেন। গত
কয়েক বছরে এমনই কয়েকজন গুল্টেমামার সন্ধান পাওয়া গেছে। এ গুল্টেমামারা অবস্থান করেন
বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। তবে দেশের রাজনীতি, আন্দোলন, আওয়ামী লীগ সরকারের
পতন এবং তাতে বিদেশি ময়মুরুব্বিদের ভূমিকা-হস্তক্ষেপ ইত্যাদি এমনভাবে প্রচার করেন,
মনে হওয়া স্বাভাবিক সরকারের পতন বুঝি হয়েই গেল। এদের প্রচারে কিছু মানুষ যে বিভ্রান্ত
হয়নি তাও কিন্তু নয়। তবে অনেকেই এ গুলবাজদের ধর্তব্যের মধ্যে আনত না। এদের নাম দিয়েছিলাম
‘প্রবাসী মৌখিক বিপ্লবী’। সরকার পতনের উদ্ভট আর ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী প্রচারে এরা এতটাই
পারঙ্গম, স্বয়ং গোয়েবলস বেঁচে থাকলে এদের গুরু মানতেন।
এ নব্য গোয়েবলসদের
একজন আমার সাবেক সহকর্মী, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত
সচিব ছিলেন। প্রশাসন ক্যাডারের এ কর্মকর্তার সহধর্মিণীও ওই সময় একই অফিসে একটি বড়
পদে নিয়োজিত ছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালে বেশ দাপটের সঙ্গেই বিরাজ করেছেন। কিন্তু ২০০৭
সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির পর তিনি সপরিবার উধাও হয়ে গেলেন দেশ থেকে।
পরে জানা গেল তিনি আছেন মার্কিন মুলুকে। সেখানে বসেই ফেসবুক আর ইউটিউবে প্রতিদিন একবার
করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে চলেছেন। এ নিয়ে দুবার তার সঙ্গে আমার মৃদৃ বাগ-সংঘাত
হয়েছে। তাকে বলেছিলাম, বিদেশে নিরাপদ ও সরকারের নাগলের বাইরে বসে এসব আজগুবি তথ্য প্রচার
না করে সাহসের বড়ি খেয়ে দেশে এসে ছাতি ফুলিয়ে কথাগুলো বলুন, আমরা স্বদেশিরা একটু সাহস
পাই। ব্যস! আমি কাট আপ তার ফেসবুক থেকে। লোকমুখে শুনি, তিনি এখনও তার গুলবাজি পুরোদমে
চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ গুলবাজদের আরেকজন
পাস করা ডাক্তার। তবে ডাক্তারি পেশা হিসেবে নেননি। করতেন ওষুধ ব্যবসা। নিজের নামে লাইসেন্স
নিয়ে ভিন্ন ফ্যাক্টরি থেকে ওষুধ বানিয়ে বাজারে বিক্রি করতেন। বগুড়ার এক ভট্টাচার্য
বংশের সন্তান এ গুল্টেমামা একসময় আওয়ামী লীগের সমমনা বামপন্থি ছাত্র সংগঠনে সংশ্লিষ্ট
ছিলেন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে হঠাৎ ভোল ও বোল পাল্টে হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগ-বিরোধী।
ফলে সরকারের বিরাগভাজন হন। এরপর একদিন অতি সংগোপনে নিকট প্রতিবেশী দেশের ওপর দিয়ে
পড়ি জমান কানাডায়। সেখানে গিয়ে রূপ ধারণ করেন অতিবিপ্লবীর। বিচিত্র মুখভঙ্গিসহকারে
এমন কদর্য ভাষায় তিনি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়।
আরেক গুল্টেমামা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছিলেন। শোনা যায়, এক ক্ষমতাধর ব্যক্তির
ব্যবসায়িক পার্টনার থাকার সময় হিসাবে নয়ছয় করায় তাকে ব্যবসা থেকে বের করে দেওয়া
হয়। এর পরই ওই কর্নেল সাহেব সপরিবার হিজরত করেন বিদেশে। সেখানে বসেই কাল্পনিক গল্প
বলে মহাবিপ্লবী সেজেছেন ভার্চুয়ালমাধ্যমে। এমন অনেক ভার্চুয়াল গুল্টেমামা ছড়িয়ে আছে
ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। তারা এমন সব আজগুবি তথ্য ইথারে ছড়িয়ে দেন যে, দেশে যারা
সরকারবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত তারাও লজ্জায় পড়ে যান। এরা বিরোধী দলকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন
রাত পোহালেই হাসিনা সরকার ‘নাই’ হয়ে যাবে। তারা বলতেন মার্কিন প্রশাসন খেপে গেছে, আর
রক্ষা নেই। তারা লীগ সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেবে না। এমনকি সরকার পতনের দিনতারিখও
দিয়ে দিতেন। তাদের কথায় মনে হতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঢাকায় এসে বিএনপির মিছিলে
যোগ দেবেন। প্রায় প্রতিদিনই চলেছে তাদের সরকার পতনের এই ‘১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত’সংবলিত
বুলেটিন প্রচার। আর এসব গুল্টেমামার হাওয়া থেকে পাওয়া তথ্যে পুলকিত হয়ে উঠত আন্দোলনরত
বিএনপির ‘শেখর থেকে শেকড়’ পর্যন্ত নেতাকর্মীর একটি অংশ। গুল্টেমামাদের কল্পিত বিপ্লবের
সাফল্যের আশার বাণীতে তারা বুক বাঁধত প্রতিদিন। এই বুঝি সেই শুভসংবাদ পাওয়া যাবেÑ সরকার
নেই। কিন্তু সেই শুভসংবাদ আর কর্ণগোচর হয়নি।
একমাত্র প্রবাসী গুলবাজদের গুলবাজির কারণেই বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির কৌশলগত ভুল এর অন্যতম কারণ। নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে না পারাটা আরও বড় কারন। আর এ কারণে ৫ টন ওজনের মালামাল বহনে সক্ষম ট্রাকে ১৫ টন পণ্য বোঝাই করার মতো কর্মসূচি দিয়েছেন তারা। এ কাজে তারা প্ররোচিত হয়েছে প্রবাসী এসব গুল্টেমামার ভুয়া প্রচারণায়। তাদের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল, রাজপথে যা-ই করি, আটলান্টিকের ওপার থেকে সওগাত তো আসছেই। সুতরাং চিন্তা কী! দাও কর্মসূচি, বসে থাকো ঘরে। আন্দোলন ব্যর্থ হলেও গুল্টেমামারা থেমে নেই। তারা এখন নতুন সরকারের আয়ুষ্কালের সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছেন। তাই শুনে এখানেও চলছে নর্তনকুর্দন! গুল্টেমামাদের এ হাওয়াই আন্দোলনে বিরক্ত মানুষ তাই বলছে, অনেক তো হলো, এবার থামলে ভালো লাগে।