× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

করোনার নতুন উপধরন

স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণই জনস্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ

ডা. মুশতাক হোসেন

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১১:১৬ এএম

ডা. মুশতাক হোসেন

ডা. মুশতাক হোসেন

করোনার নতুন উপধরন জেএন.১ ইতোমধ্যে বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে। ১৮ জানুয়ারি আইইডিসিআরের তরফে এ তথ্য জানানো হয়। এর আগে বিশ্বের কয়েকটি দেশে নতুন উপধরনটির সন্ধান মিলেছে। ১৮ জানুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর প্রতিবেদনে প্রকাশ, প্রতিবেশি দেশ ভারতসহ ৪১ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার নতুন ধরন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে একে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা এর দিকে নজর রাখার মতো ধরন বলেছে। জেএন.১ ধরনটি দ্রুত ছড়াচ্ছে যা উদ্বেগের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত এ তিনটি দেশে করোনার নতুন উপধরনটি দ্রুত ছড়াচ্ছে। আমরা জানি, দেশ থেকে বহুসংখ্যক মানুষ এ তিনটি দেশেই যাতায়াত করে। প্রতিটি ভাইরাসের গায়ে কাঁটার মতো স্পাইক প্রোটিন থাকে। এরাই মানবশরীরে প্রবেশ করে কোষগুলো আক্রান্ত করে, নানা উপসর্গ সৃষ্টি করে। স্পাইকের মিউটেশন বা চরিত্র পরিবর্তনের ফলে নতুন কোনো ধরন বা উপধরনের সৃষ্টি হয়।

অমিক্রনের একটি উপধরন হলো জেএন.১। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ফাঁকি দেওয়ায় জেএন.১ আরও অনেক বেশি কার্যকর। ফলে এর সংক্রমণের হার বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্যানুযায়ী, অমিক্রনের বিএ.২.৮৬ ধরনটির স্পাইক প্রোটিনে ২০টি মিউটেশন আছে। আর জেএন.১-এ আছে ২১টি। এ অতিরিক্ত মিউটেশনটির নাম দেওয়া হয়েছে এল৪৫৫এস। টিকার কারণে যে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তা দিয়ে জেএন.১ থেকে কতটুকু সুরক্ষা মিলবে, সে ব্যাপারে খুব বেশি প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবে আগের ধরনগুলোর চেয়ে এ ধরনে সংক্রমণের কারণে মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি অসুস্থ হচ্ছে, এমন তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তার পরও এ সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং নতুন উপধরনটি স্বাস্থ্যের ওপর কেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা স্পষ্ট না হওয়ায় বাড়তি সতর্কতার বিকল্প নেই।

স্বাস্থ্য খাতে যেকোনো সংকটের ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ থাকা জরুরি। গত করোনা দুর্যোগে আমরা দেখেছি, সরকার এবং চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকের প্রাণান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ও বেসরকারি চিকিৎসা ক্ষেত্রের কিছু অসাধু নিজেদের আখের গোছাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি বিদেশপ্রত্যাগতদের করোনা সার্টিফিকেট নিয়েও তারা তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। এ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নানাবিধ কর্মসূচি ও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। স্বাস্থ্য খাতের জন্য ডেঙ্গু এখনও সংকট হিসেবেই আমাদের সামনে রয়েছে। অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমানে যে দুর্যোগের সংকেত আমরা ফের পেলাম এ প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য খাতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সনাতন চিকিৎসাপদ্ধতি অনুসরণ করলে চলবে না। আধুনিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতের সামনে বাড়তি চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইতোমধ্যে কথাবার্তা কম হয়নি। বিগত প্রায় এক মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণহানির চিত্রও কম স্ফীত নয়। ডেঙ্গু মোকাবিলায় ব্যবস্থাসম্পন্ন বিশেষায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এ বিশেষায়িত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে করোনার উপধরনের জন্য গড়ে তোলা সমন্বিত পরিকল্পনা সংযুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে। সরকার নিজ উদ্যোগে চিকিৎসাসেবা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিলে এর সুফল দৃশ্যমান হতে বাধ্য।

জেএন.১ কম ক্ষতিকর হলেও বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু, অন্তঃসত্ত্বা ও যাদের কোমরবিডিটি (একই সঙ্গে থাকা একাধিক রোগ) আছে, তাদের জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমরা জানি, শীতে ঠান্ডা, সর্দি, কাশি, জ্বর ইত্যাদি অসুস্থতায় বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু, নারী আক্রান্ত হয় বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঝুঁকিসংক্রান্ত এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, বিশেষ করে যেসব দেশে শীত মৌসুম শুরু হচ্ছে, সেখানে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত অন্য সংক্রমণগুলোর পাশাপাশি করোনার এ নতুন ধরনের কারণে সারস-কোভি-২ (করোনাভাইরাস)-এর প্রকোপ বেড়ে যেতে পারে। সংস্থাটি মনে করছে, জনস্বাস্থ্যের ওপর এ ধরনের প্রভাব নির্ণয়ের জন্য আরও বেশি গবেষণা প্রয়োজন। করোনার নতুন উপধরন এজন্যই উদ্বেগের। করোনাকালে যেসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে তাগাদা দেওয়া হয়েছিল সেগুলো আবার জোরদার করা জরুরি। অর্থাৎ আমাদের ফিরে যেতে হবে পুরোনো অভ্যাসে। করোনার টিকা বিগত সরকার নানা উৎস থেকে সংগ্রহ করে সকল পর্যায়ে প্রদানের সাফল্য দেখিয়েছে। এমনকি মোট জনগোষ্ঠীর বৃহদাংশ বুস্টার ডোজও পেয়েছে। সরকারের এ সাফল্য ম্লান করতে সরকারেরই কিছু অসাধু ব্যক্তি নিজেদের আখের গোছাতে কদাচারের ছড়াছড়ি ঘটিয়েছিল। এমনটি যেন কেউ আর না করতে পারে সেজন্য পুরো ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় তদারকির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার প্রশাসন, স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষায়িত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসা যেতে পারে। এ মুহূর্তে আমাদের সমন্বয়মূলক ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে।

আমরা দেখেছি, অতীতে বারবার সতর্কবার্তা জারির পরও যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে অনেকের অনাগ্রহ ছিল এবং এর বিরূপ প্রভাব হয়েছিল নানামুখী। শুধু তাই নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ ও নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় মনিটরিং কমিটির পরামর্শ অতীতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি এ অভিযোগ আছে। গত করোনা দুর্যোগে আমাদের স্বাস্থ্য খাতের নানাবিধ অসঙ্গতি দৃশ্যমান হয়েছিল। বিশেষ করে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চিকিৎসাব্যবস্থার পথ মসৃণ করা যায়নি। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয়ের মধ্যে আকাশপাতাল তফাত, অভিযোগ আছে এও। জরুরি পরিস্থিতিতে যদি অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম টিকে থাকে তাহলে স্বাস্থ্য খাতে অস্থিতিশীল পরিবেশ ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। স্বাস্থ্য খাতের এ সমস্যা বড় শহরগুলোতেই বেশি দেখা যায়। স্বীকার করে নিতে হয়, রাজধানীতে জনস্বাস্থ্যের কোনো কাঠামো নেই। হাসপাতালগুলো নিছক চিকিৎসাকেন্দ্র। স্বাস্থ্যসেবা বলতে শুধু চিকিৎসা বোঝায় না। স্বাস্থ্যসেবা রোগপ্রতিরোধ, প্রাথমিক চিকিৎসা ও মানসিক আস্থার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখে। রাজধানীতে বড় হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কয়েকটি আলাদা গণহাসপাতাল গড়ে তোলা জরুরি। তা ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডেও একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র থাকা দরকার। অতীতের ঘাটতিগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্ভাব্য দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি নিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে ইতোমধ্যে আরও সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এসব সামাল দিয়ে পাশাপাশি করোনা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

করোনার নতুন উপধরন সম্ভাব্য দুর্যোগ সম্পর্কে শুধু স্বাস্থ্যবিধির অনুসরণ এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর ব্যাপারে দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর বক্তব্য কিংবা সতর্কবার্তা প্রদানই যথেষ্ট নয়; স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে কি না এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রতিরোধের ব্যবস্থা মসৃণ হলে স্বাস্থ্য খাতের ওপর বাড়তি চাপ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। করোনার এ নতুন উপধরন আগের ধরনগুলোর মতো অত ভয়াবহ নয়। তবে এখনই চূড়ান্ত কিছু বলা কঠিন। এজন্য বাড়তি সতর্কতার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। শীতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন ডি গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের ৭০-৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ভিটামিন ডি-স্বল্পতায় ভুগছে। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের বিষয়টি ব্যক্তিসচেতনতার ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে করোনার সংক্রমণ কমানো সম্ভব হবে। জীবনযাত্রায় কেমন পরিবর্তন আনলে মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে, এ বিষয়েও সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

জাতীয় পরিসরে জনস্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তোলা না গেলে হাসপাতালে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা জিইয়ে থাকবেই। একটি সুশৃঙ্খল ও সমন্বয়মূলক ব্যবস্থার দিকে এগোতে হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বভার যার ওপর অর্পণ করেছে তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বটে, তবে এ খাতের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক খ্যাতিমান চিকিৎসক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন দায়িত্বভার গ্রহণ করে এ খাতের ব্যাপারে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা সাধুবাদযোগ্য। ইতোমধ্যে তিনি হাসপাতালে অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কাজও শুরু করেছেন। চিকিৎসাক্ষেত্রে তার অতীত কর্মপদক্ষেপের আলোকে প্রত্যাশাÑ একটি আদর্শ জনস্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তোলা হবে। স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা ভঙ্গুর তা সত্য। তবে জনস্বাস্থ্যকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হলে বিদ্যমান সংকট দূর করা দুরূহ হবে না।

আতঙ্ক নয়, বরং জরুরি সচেতনতা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। করোনার নতুন উপধরন জেএন.১ সংক্রমণ দেশে দেশে বাড়ছে, এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রেখে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় অধিক জোর দিতে হবে। ফিরে যেতে হবে আমাদের সেই পুরোনো অভ্যাসে, যা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার রক্ষাকবচ। একই সঙ্গে রোগ নির্ণয়-পরীক্ষা ব্যবস্থাসহ চিকিৎসাব্যবস্থার পথ সুগম করতে হবে। আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে তা অসত্য নয়, কিন্তু সামর্থ্য যেটুকু আছে তা যথাযথভাবে কাজে লাগানোই মূল চ্যালেঞ্জ।

  • জনস্বাস্থ্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ। আইইডিসিআরের সাবেক উপদেষ্টা
শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা