‘আমরা সবাই/ এখানে এসেছি কেন? এখানে কী কাজ আমাদের?/ কোন সে জোয়ার/ করেছে নিক্ষেপ আমাদের এখন এখানে এই/ ফাল্গুনের রোদে? বুঝি জীবনেরই ডাকে/ বাহিরকে আমরা করেছি ঘর, ঘরকে বাহির’। শামসুর রাহমানের বিখ্যাত ‘আসাদের শার্ট’ কাব্যগ্রন্থের ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতার পঙক্তি বলে দেয়, ঊনসত্তরের রাজনৈতিক উত্তাপে কতটা বদলে যাচ্ছিল ঢাকা। বায়ান্নর পর থেকেই জাতীয় রাজনীতির কণ্ঠস্বর পাল্টে যেতে শুরু করেছিল। ঊনসত্তরে তা আরও জোরালো হয়ে ওঠে। আইয়ুব খানের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ‘৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়। জনজীবনে প্রবেশ করেছিল স্লোগানের ভাষা। ঐতিহাসিকভাবে যে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণিচ্যুতির ভয়ে অভ্যুত্থান, বিপ্লব বা বিদ্রোহ থেকে নিজেদের রেখেছে দূরে, তারাও সময়ের স্রোতের ধাক্কা অস্বীকার করতে পারেনি।
ঘটনার সূত্রপাত
এক ছাত্র অসন্তোষ থেকে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে নিহত
হন। গণ-আন্দোলনের প্রথম শহীদ আসাদের মৃত্যুর প্রতিবাদে সে সময় দেশব্যাপী শোক কর্মসূচি
চলছিল। কর্মসূচির মধ্যে ছিল ২২ জানুয়ারি শোক মিছিল, কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন;
২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মশাল মিছিল, পরে কালো পতাকাসহ শোক মিছিল এবং ২৪ জানুয়ারি দুপুর
২টা পর্যন্ত হরতাল। ছাত্র অসন্তোষের এই আন্দোলনে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। ইতিহাসের
নানা গ্রন্থের সূত্র অনুসারে, ২২ জানুয়ারি এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে কালো পতাকা উত্তোলন
করা হয়নি। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যার পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে মশাল
মিছিল বের হয়। সমগ্র ঢাকা পরিণত হয় মশালের নগরীতে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত এই ক্ষোভ শাসকরা
ভালো দৃষ্টিতে দেখেনি। ২৪ জানুয়ারি পুলিশ গুলি করে মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীরÑ
এই চারজনকে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ রাজপথে নেমে আসে। বিশেষ করে, মৃত্যুর
আগে মাকে লেখা নবম শ্রেণির ছাত্র কিশোর মতিউরের হৃদয়বিদারক চিঠি আন্দোলনমুখী মানুষকে
আরও খেপিয়ে তোলে। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘মা-গো, মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি মা, মনে
করো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছে।
ইতিÑ মতিউর রহমান, ১০ম শ্রেণী, নবকুমার ইনস্টিটিউট। পিতা- আজহারউদ্দীন মল্লিক, ন্যাশনাল
ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ ২৪ জানুয়ারি তিন দিনের কর্মসূচির শেষ দিন ছিল অর্ধদিবস হরতাল।
হরতাল কর্মসূচি শেষে পল্টনে লাখো মানুষ জমায়েত হয়। শেখ মুজিব কবে মুক্তি পাবেন? আগরতলা
মামলা কবে তুলে নেওয়া হবেÑ এই প্রশ্ন সবার। জনতার জোয়ারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এমন
সংগ্রাম গড়ে তোলা হবে যাতে শেখ মুজিবকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসা যায়।
দেশের মানুষ ঠিকই বুঝেছিল, ‘আইয়ুব-মোনায়েমের পতন না হলে শেখ মুজিব মুক্তি পাবেন না।’
ক্ষুব্ধ জনতা
আগরতলা মামলার সাক্ষী, বিচারপতি এমনকি তৎকালীন কয়েকজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দেয়। ২৪
জানুয়ারির ঘটনার পরই মূলত গণ-আন্দোলন পশ্চিমা শাসকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মারমুখী
ছাত্র-জনতাকে দমন করতে পুলিশ ও ইপিআর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান বাঙালি
জাতির স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মাইলফলক। আসাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ঊনসত্তরের
গণ-অভ্যুত্থানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মতিউরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই গণ-অভ্যুত্থান
পূর্ণতা লাভ করে। এই আন্দোলন শুধু ছাত্র বা রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল
না, একপর্যায়ে কৃষকদের মধ্যে, শ্রমিকদের মধ্যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে
ছড়িয়ে পড়েছিল বলেই তা হয়ে উঠেছিল গণ-অভ্যুত্থান।